উন্নয়নের নির্দেশক বা সূচকগুলি আলোচনা করো | Discuss the Indicators of Development

Photo of author

Follow G-News

অন্যদের শেয়ার করুন

উন্নয়ন সূচকসমূহ প্রভাব (Types of Development Indicators and Indices):

সমাজচিন্তাবিদ ও অর্থনীতিবিদরা একটি দেশ বা একটি অঞ্চলের মানব উন্নয়ন মূল্যায়ন করতে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন সূচক বা মেট্রিক্স ব্যবহার করেন। এর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সূচক হল-

(ক) মানব উন্নয়ন সূচক (Human Development Index বা HDI): মানব উন্নয়ন পরিমাপ করার জন্য মানব উন্নয়ন সূচক বা HDI প্রস্তুত করা হয়। ১৯৯০ সাল থেকে প্রতি বছর UNDP মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের HDI-এর পরিমাপ প্রকাশ করে চলেছে। মানব উন্নয়ন সূচকের মূল কথা হল, উন্নয়ন পরিমাপ করা হবে দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের আলোকে, মোট জাতীয় উৎপাদন দিয়ে উন্নয়ন পরিমাপ করা যাবে না। HDI-এ জীবনযাত্রার মান নির্ণয়ের উপাদানগুলি হল- (১) জীবনের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল, (২) প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার হার এবং (৩) ক্রয়ক্ষমতা। মানব উন্নয়ন সূচক বেড়ে যাওয়ার অর্থ হল দেশের মানুষের সামগ্রিক উন্নতি ঘটা।

(খ) মাথাপিছু জি.এন.পি. সূচক (Per capita GNP Index): উন্নয়ন পরিমাপের সনাতন এবং সর্বাধিক ব্যবহৃত সূচক হল মাথাপিছু জি.এন.পি. সূচক। একটি নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত এক বছরে) একটি

দেশের অর্থনীতিতে যেসব চূড়ান্ত দ্রব্য এবং পরিষেবা উৎপাদিত হয় সেগুলির সমষ্টিকে প্রচলিত বাজার দরে মূল্যায়ন করে মোট আভ্যন্তরীন উৎপাদন (Gross Domestic Product বা GDP পাওয়া যায়। GDP-র সাথে নীট উপকরণ আয় যোগ করলে মোট জাতীয় উৎপাদন (Gross National Product বা GNP পাওয়া যায়। এই মোট GNP-কে সে দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু GNP পাওয়া যায়। GNP সূচকে উন্নয়ন পরিমাপে মাথাপিছু প্রকৃত আয়কে মানদণ্ড হিসাবে ধরা হয়। এতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় মাথাপিছু প্রকৃত আয় যদি বেশি হয় তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে বলে ধরা হয়।

(গ) জীবনের ভৌতমান সূচক (Physical Quality of Life Index বা PQLI): ১৯৭৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘Overseas Development Council’-এর উদ্যোগে অর্থনীতিবিদ Morris David Morris উন্নয়ন পরিমাপের জন্য ভৌত মান সূচক বা Physical Quality of Life Index-এর উদ্ভাবন করেন। Morris এক্ষেত্রে তিনটি নির্দেশক ব্যবহার করেন। এগুলি হল আয়ুষ্কাল, শিশু মৃত্যুর হার এবং সাক্ষরতা বা শিক্ষার হার। এই তিনটি নির্দেশককে পৃথক হিসাব করে সবগুলো মিলিয়ে ১০০ মাত্রা ধরে PQLI বের করা হয়।

(ঘ) রাজনৈতিক স্বাধীনতা সূচক (Political Freedom Index বা PFI): মানব উন্নয়নের উদ্দেশ্য হল জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটানো, যার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক স্বাধীনতা। রাজনৈতিক স্বাধীনতার গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের Human Development Report-র উন্নয়ন পরিমাপের Political Freedom Index বা PFI উদ্ভাবন করা হয়। রাজনৈতিক স্বাধীনতা সূচকের পাঁচটি উপাদান হল ব্যক্তিগত নিরাপত্তা (Personal Security), আইনের শাসন (Rule of Law), মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (Freedom of Expression), রাজনৈতিক অংশগ্রহণ (Political Participation) এবং সুযোগ সুবিধার সমতা (Equality of Opportunity)।

(ঙ) লিঙ্গ উন্নয়ন সূচক (Gender Development Index বা GDI): লিঙ্গ উন্নয়ন সূচক হল লিঙ্গ সমতা পরিমাপের একটি সূচক। জাতিসংঘের উন্নয়ন পরিকল্পনায় ১৯৯৫ সালে লিঙ্গ উন্নয়ন সূচককে (Gender Development Index) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই পরিমাপ সূচকের লক্ষ্য ছিল মানব উন্নয়ন সূচকে (HDI) একটি লিঙ্গ সংবেদনশীল মাত্রা যোগ করা। এই সূচক দ্বারা জীবন সম্ভাবনা, শিক্ষা ও আয়ের ক্ষেত্রে লিঙ্গ ব্যবধানকে পরিমাপ করা হয়। দেশের জাতীয় আয় মহিলা ও পুরুষদের মধ্যে কিভাবে বণ্টন হয় তার উপর নির্ভর করে দেশে মহিলা ও পুরুষ কি মাত্রায় সুন্দর জীবন যাত্রার মান বজায় রাখতে পারবে। দেশে মহিলা ও পুরুষদের প্রত্যাশিত আয়ু কতদিন বজায় থাকবে অর্থাৎ তারা কতদিন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে সেটিও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি বিচার্য বিষয়। এছাড়া আরো একটি বিচার্য বিষয় হল দেশের মহিলা ও পুরুষ উভয়েই কি পরিমাণ শিক্ষার অধিকারী হতে পারছে। এই সমস্ত বিচার্য বিষয়গুলি যৌথভাবে লিঙ্গভিত্তিক উন্নয়ন সূচকের (GDI) মাধ্যমে বিবেচনা করা হয়।

কোনো দেশে যদি লিঙ্গ বৈষম্য না থাকে তাহলে দেশটির মানব উন্নয়ন সূচক (HDI) এবং লিঙ্গ উন্নয়ন সূচক (GDI)-এর মান সমান হবে। তা না হলে লিঙ্গ উন্নয়ন সূচকের (GDI) মান মানব উন্নয়ন সূচকের (HDI) মান অপেক্ষা কম হবে। এই দুটি সূচকের মানের পার্থক্য যত বেশি হবে দেশটির লিঙ্গ বৈষম্যও অধিক হবে (নন্দী ২০১৯)।

চ) লিঙ্গ ক্ষমতায়ন সূচক (Gender Empowerment Measure বা GEM): জাতিসংঘের উন্নয়ন পরিকল্পনায় ১৯৯৫ সালে লিঙ্গ ক্ষমতায়ন সূচককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মূলত লিঙ্গ সমতাকে পরিমাপ করার জন্য এই সূচকটিকে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে দেখা হয় যে, পুরুষ এবং নারীরা অর্থনৈতিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম কিনা। GEM-এ তিনটি নির্ধারক ব্যবহৃত হয়। যথা- (১) প্রশাসনের বা সরকারের নীতি নির্ধারণে মহিলা ও পুরুষের আপেক্ষিক ক্ষমতা এবং রাজনীতিতে মহিলা পুরুষের অংশগ্রহণের মাত্রা (২) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণে মহিলা ও পুরুষের আপেক্ষিক ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মহিলা ও পুরুষের অংশগ্রহণের মাত্রা (৩) অর্থনৈতিক সম্পদের উপর মহিলা ও পুরুষের আপেক্ষিক ক্ষমতা।

আরও পড়ুন: উন্নয়ন বলতে কী বোঝায়? উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা করো।

(ছ) মানব দারিদ্র সূচক (Human Poverty Index বা HPI): রাষ্ট্রসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি অনুসারে ১৯৯৭ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে ‘মানব দারিদ্র সূচক’-এর ধারণা প্রবর্তিত হয়। মানব দারিদ্র সূচক (HPI) হল মানব জীবনের তিনটি মূল ক্ষেত্রের বঞ্চনার (Deprivation) পরিমাপ। এগুলি হল দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবন, জ্ঞান বা শিক্ষা এবং একটি সুন্দর জীবনযাত্রা। বঞ্চনার প্রথম দিক হল অপেক্ষাকৃত কম বয়সে মৃত্যু এবং এটি মানব দারিদ্র সূচকে (HPI) প্রকাশ করা হয় জনসাধারণের কত শতাংশ চল্লিশ বছর বয়সের পূর্বে মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে তার মাধ্যমে। বঞ্চনার দ্বিতীয় দিক হল জ্ঞান ও শিক্ষা সম্পর্কিত এবং এটি পরিমাপ করা হয় প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার কত শতাংশ অশিক্ষিত তার মাধ্যমে। বঞ্চনার তৃতীয় দিক হল সুন্দর জীবনযাত্রা সম্পর্কিত এবং এটি প্রকাশ করা হয় যৌথভাবে তিনটি বিষয়ের মাধ্যমে। এই তিনটি বিষয় হল জনসাধারণের কত শতাংশ স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণের ক্ষমতা আছে, কত শতাংশের পানীয় জল গ্রহণের ক্ষমতা আছে এবং পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশু কত শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছে।

Organisation of Economic Cooperation-এর অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি নির্বাচিত দেশ মানব দারিদ্র সূচকে (HPI) মানব জীবনের চারটি মূল ক্ষেত্রের বঞ্চনা বিবেচনা করে। এই চারটি মূল ক্ষেত্র হল-
(১) জনসাধারণের কত শতাংশের জন্মের পর আয়ু ষাট বছরের বেশি না হওয়ার সম্ভাবনা।
(২) জনসংখ্যার কত শতাংশ দারিদ্র রেখার নীচে অবস্থিত।
(৩) প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার কত শতাংশের স্বাভাবিক কাজকর্মের জন্য সাক্ষরতার অভাব আছে। (৪) দীর্ঘকালীন বেকারত্বের হার (নন্দী ২০১৯)।

Leave a Comment