গৌড়ের পরিবহন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো।

By

গৌড়ের পরিবহন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো। (Discuss the transport system of Gaur.)

ভূমিকা : গৌড় হল উত্তরবঙ্গের একটি ঐতিহাসিক শহর এবং ধ্রুপদী ও মধ্যযুগীয় সময়ের একটি বিশিষ্ট্য রাজধানী। গৌড় অঞ্চলটি সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্ক দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গৌড় অঞ্চলটি বেশ কয়েকটি সম্রাজ্যের অধীনে ছিল। যেমন – পাল সাম্রাজ্য, সুলতানি আমল, মুঘল আমল প্রভৃতি। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে গৌড় অঞ্চলের মধ্যে যেমন সাম্রাজ্য পরিবর্তন হয়েছে তেমনি অঞ্চলটির নামেরও পরিবর্তন ঘটেছিল। যেমন – পাল সাম্রাজ্যে গৌড়, সুলতানি আমলে লখনৌতি,  মুঘল আমলে আবার গৌড় নাম। 

গৌড়ের পরিবহন ব্যবস্থা : গৌড় অঞ্চলটি একসময় বিভিন্ন রাজবংশ ও সাম্রাজ্যের অধীনে থাকায় গৌড়ের পরিবহন ব্যবস্থা ঐতিহাসিক আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। গৌড়ের পরিবহন ব্যবস্থা সম্পর্কে নিন্মরূপ আলোচনা করা হল :

1. নদী পরিবহন : শহরটি গঙ্গা নদীর কাছে অবস্থিত ছিল, যা এই অঞ্চলকে বাণিজ্যকেন্দ্রিক এবং প্রয়োজনীয় জলের প্রধান উৎস হিসাবে গড়ে তুলেছিল। গঙ্গা নদীর মাধ্যমেই গৌড় অঞ্চলের বিভিন্ন পণ্য, মানুষ এবং সামরিক বাহিনী এখান থেকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এবং তার বাইরে রপ্তানি করা হত। ধীরে ধীরে গঙ্গা নদীটি গৌড় শহরের আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যম হয়ে ওঠে এবং গৌড় শহরে নদী পরিবহন এর সূত্রপাত ঘটে থাকে। নদীটি শহরের চারপাশের কৃষি জমির জন্য সেচ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও করেছিল। শহরটির মধ্যে বেশ কয়েকটি পরিবহন ঘাট বা অবতরণের জায়গা ছিল, যেখানে নৌকা ও জাহাজগুলি তাদের পণ্য লোড এবং আনলোড করতে পারত। এই শহরের কিছু ঘাটের নামকরণ করা হয়েছিল শাসক বা অভিজাতদের নামে অনুসারে। যেমন – সুলতানপুর ঘাট, হোসেন শাহী ঘাট এবং ফিরোজ শাহী ঘাট। 

আরও পড়ুন:  গৌড় সম্পর্কে আলোচনা করো?

2. সড়ক পরিবহন : এই শহরটি পান্ডুয়া, রাজমহল, মুর্শিদাবাদ এবং ঢাকার মতো বাংলার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহর ও অঞ্চলের সাথে সড়ক পথ দ্বারা সংযুক্ত ছিল। এই সড়ক পথগুলি  সামরিক অভিযান এবং তীর্থযাত্রার জন্যও ব্যবহৃত হত। এই অঞ্চলের কিছু সড়ক ইট বা পাথর দিয়ে পাকা করা হয়েছিল, আবার কিছু সড়ক পথ ছিল কাঁচা। সড়কগুলি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা রাজকীয় কর্মকর্তারা রক্ষণাবেক্ষণ করত, যারা ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে  কর আদায় করত। সড়কগুলি দুর্গ এবং প্রহরী টাওয়ার দ্বারা সুরক্ষিত ছিল, যার ফলে এই সড়ক গুলিতে ভ্রমনকারী মানুষদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল। এই শহরের এবং এর আশেপাশের কিছু উল্লেখযোগ্য রাস্তা এবং দুর্গ হল – লুকোচুরি দরওয়াজা, দাখিল দরওয়াজা, কোতোয়ালি দরওয়াজা, নিমাসরাই দুর্গ এবং রামকেলি দুর্গ।

আরও পড়ুন:  ডুয়ার্স বলতে কোন অঞ্চলকে বোঝায়? ডুয়ার্স অঞ্চল সম্পর্কে আলোচনা করো?

3. পশু পরিবহন : পূর্বে গৌড় শহরটি পরিবহন এর জন্য বিভিন্ন পশুর ওপর নির্ভরশীল ছিল। যেমন – ঘোড়া, হাতি, উট, বলদ এবং গাধার প্রভৃতি। সেই সময়ে এই প্রাণীগুলি দ্বারাই এক স্থান থেকে অন্যস্থানে মানুষ, পণ্য এবং অস্ত্র বহন করা হত। আবার এগুলি আনুষ্ঠানিক এবং বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যেও ব্যবহৃত হত, যেমন শিকার, দৌড় প্রতিযোগিতা প্রভৃতি। সেই সময়ে এই অঞ্চলের পরিবহন ব্যবস্থা বৃদ্ধি করার জন্য কিছু প্রাণী অন্য অঞ্চল বা দেশ (যেমন – আরব, পারস্য এবং মধ্য এশিয়া) থেকেও আমদানি করা হয়েছিল। 

উপসংহার : গৌড়ের পরিবহন ব্যবস্থা ছিল এই শহরের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এবং গতিশীলতার প্রতিফলন। গৌড় শহরটি বিভিন্ন সম্রাজ্যের অধীনে থাকার মধ্য দিয়ে তার পরিবহন ব্যস্থার উন্নতি ঘটালেও 16 শতকের পর এই শহরে পরিবহন ব্যবস্থার হ্রাস দেখতে লক্ষ্য করা যায়। এই শহরটি শের শাহ সুরি এর সাম্রাজ্য থেকে মুক্ত পাওয়ায় এবং পরবর্তী সময়ে এই শহরে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ও গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ার ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যায়। ফলস্বরূপ শহরটি তার কৌশলগত গুরুত্ব এবং পরিবহন ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে যায়। গৌড় শহরের পরিবহন ব্যবস্থার অবশিষ্টাংশের কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেমন লুকাচরি গেটওয়ে, দাখিল দরওয়াজা, ফিরোজ মিনার, কদম রসূল মসজিদ, ছোট সোনা মসজিদ, মুঘল তাহাখানা, প্রভৃতি।

আরও পড়ুন:  উত্তরবঙ্গের জৈন ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করো?

Leave a Comment