টিকা লেখো : পান্ডুয়া

By

পান্ডুয়া সম্পর্কে টীকা লেখো। 

ভূমিকা : পান্ডুয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ জেলার একটি ঐতিহাসিক শহরের ধ্বংসাবশেষ। পান্ডুয়া 1353 সালে সুলতান ইলিয়াস শাহ কতৃক প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে এর নাম করে ফিরুজাবাদ রাখা হয়। এই শহরটি ছিল সেই সময়ের বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং এখানে বিভিন্ন অঞ্চল ও ধর্মের লোকের বসতি ছিল। গৌড় শহরের মতো প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ না হলেও পান্ডু নগরীতে বহু হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এই শহরটি সেই সময়ের সাময়িক ঘাটি হওয়ার পাশাপাশি সূক্ষ্ম টেক্সটাইল, কাগজ, মদিরা এবং মুদ্রা তৈরিতে বিশেষ অবদান রয়েছে।  1450 খ্রিস্টাব্দে রাজধানী গৌড়ে স্থান্তরিত হওয়ার পর পান্ডুয়া শহরটি তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। বর্তমান সময়ে এই শহরটির শুধুমাত্র কিছু স্মৃতিস্থম্ভ অবশিষ্ঠ রয়েছে।

নামকরণ : সুলতান ইলিয়াস শাহ 1353 খ্রিস্টাব্দে সুলতান ফিরুজ শাহ এর নাম অনুসারে পান্ডুয়া এর নামকরণ করেন ফিরুজাবাদ। আবার অনেকের মতে, পান্ডুয়া শহরটির নামকরণ করা হয় পান্ডুইয়া>পান্ডুভিয়া থেকে। তবুও কানিংহামের মতে, পান্ডুবিস নামক জলজ পাখির নাম অনুসারেই পান্ডুয়া শহরটির নামকরণ করা হয়। 

আরও পড়ুন:  উত্তরবঙ্গের জৈন ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করো?

পান্ডুয়া নগরীর ইতিহাস : পান্ডুয়া হল বর্তমান বাংলার মালদাহ জেলার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর। এই শহরটি 114 বছর (1339 – 1453) এর জন্য বাংলা সালতানাতের প্রথম রাজধানী ছিল। শহরটি এখন সমর্থকভাবে আদিনা নামে পরিচিত। এই শহরটির ঐতিহাসিক আলোচনা নিন্মে করা হল :

(ক) স্থাপত্য ও স্মৃতিসৌধ : এই শহরটির মধ্যে বাংলা, আরব এবং ফার্সি স্থাপত্যের উপাদান রয়েছে। এই শহরের মধ্যে ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও স্মৃতিসৌধ গুলির অবস্থান রয়েছে, যেমন – আদিনা মসজিদ, একলাখী সমাধি, কুতুব শাহি মসজিদ, সুলতানের পুত্রের সমাধি প্রভৃতি। এই শহরের প্রাক্তন সময়ের রাজার রাজপ্রসাদের কিছু অবশিষ্ঠ নেই শুধু তার টিলার অংশবিশেষ ছাড়া। 

(খ) ইতিহাস এবং সংস্কৃতি : পান্ডুয়া শহরের লোকেরা বৈচিত্র্যময় এবং সর্বজনীন ছিল, কারণ তারা ইউরেশিয়া জুড়ে স্থানীয়, রাজপরিবার, অভিজাত এবং বিদেশিদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের মতো বিভিন্ন ধর্ম অনুসরণ করত এবং বাংলা, ফার্সি, আরবি এবং সংস্কৃতের মতো বিভিন্ন ভাষায় কথা বলত। 

আরও পড়ুন:  টীকা লেখো : পুন্ড্রবর্ধন | পুন্ড্র কারা ছিল ?

(গ) বাণিজ্য কেন্দ্রিক : সেই সমসাময়িক সময়ে শহরটি ছিল বাণিজ্য কেন্দ্রিক শহর এবং একটি বিলাসবহুল শহর। এই শহরটি কাপড় এবং মদ্য জাত পণ্যের রপ্তানির দিক থেকে উন্নয়নশীল ছিল। এখানকার বণিকরা বিদেশে বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে জাহাজ তৈরি করতেন এবং বিদেশে তাদের পণ্য রপ্তানি করতেন। এই শহরটির দ্রব্য উৎপাদনের কেন্দ্র হওয়ার কারণে বহু দ্রব্য উৎপাদিত হত। যেমন – সূক্ষ্ম মসলিন সিল্ক, ওয়াইন, কাগজ প্রভৃতি। 

(ঘ) বসতির প্রকৃতি : পান্ডুয়া শহরের লোকেরাও অনেক চ্যালেঞ্জ এবং দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়েছিল, কারণ তারা প্রায়ই দিল্লি সালতানাত, মঙ্গোল, আফগান এবং স্থানীয় হিন্দু রাজাদের রাজত্বের সম্মুখীন হয়েছিল। তারা অনেক যুদ্ধ, বিদ্রোহ এবং আক্রমণ প্রত্যক্ষ করেছে, যার ফলে কখনও কখনও তাদের শহর ধ্বংস হয়েছে এবং তাদের প্রাণহানি হয়েছে। তারা বন্যা, দুর্ভিক্ষ এবং মহামারীর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকারও হয়েছিল, যা তাদের জীবিকাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।

আরও পড়ুন:  দার্জিলিং এর চা চাষ সম্পর্কে যা জানো আলোচনা করো।

উপসংহার : পান্ডুয়া শহরটি এমন সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যখন বাংলা সালতানাত ছিল একটি শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ রাজ্য যা পূর্ব ভারতের বেশিরভাগ অংশ শাসন করত। পান্ডুয়া 1339 থেকে 1453 সাল পর্যন্ত এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সালতানাতের রাজধানী ছিল এবং সংস্কৃতি, বাণিজ্য এবং শিক্ষার কেন্দ্র ছিল। পান্ডুয়া শহরের ধ্বংসাবশেষ এখন তার ইতিহাসগুলি গল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন করছে। পান্ডুয়া শহরটি এমন একটি গৌরবময় এবং অশান্ত যুগের অংশ ছিল, যা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে রূপ দিয়েছিল। 

বাংলার সুলতানরা পারস্য রাজাদের ঐতিহ্য অনুকরণ করতেন। শের শাহ সুরির বিজয়ের পর শহরটি ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে শুরু করে এবং ভূমিকম্প ও আদ্রতার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে সর্বশেষে হারিয়ে যায়। 

Leave a Comment