বর্তমান যুবক-যুবতীদের উপর গণমাধ্যমগুলির ভূমিকা – প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা: সামাজিকতার বন্ধনে আবদ্ধ মানবজাতির কাছে যোগাযোগ ব্যবস্থা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একে অপরের সাথে যোগাযোগের এই বিচিত্র ইচ্ছাই মানবজাতিকে শিখিয়েছে বিপদের দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর ভেদ করে অজানাকে জানতে এবং অচেনাকে চিনতে। তাই তো, নানা বিপদের সম্মুখীন হয়েও সে আজ দুনিয়াকে এনেছে নিজের হাতের মুঠোয়। তাই কোনো কিছুই আজ আর অজ্ঞাত নেই বা যোগাযোগের বাইরে নেই। এই যোগাযোগ ব্যবস্থার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট একটি মাধ্যম হল গণমাধ্যম। বর্তমানে আট থেকে আশি সবাই গণমাধ্যমের জ্বরে আক্রান্ত।

গণমাধ্যমের ইতিহাস: গণমাধ্যমের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় আজ গণমাধ্যমের যে বিজয় পতাকা সগর্বে উড়ছে শুরুর দিকে ততটাই সহজ ছিল না। গণমাধ্যমের সূচনা হিসেবে বলা যেতে পারে বিদেশে আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে হাতে লেখা এক ধরনের সংবাদপত্র বিলি করা হত। যদিও তা সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ভারতেও মুঘল রাজত্বকালে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে হাতেলেখা সংবাদপত্র পড়ার চল ছিল। তবে যদি আধুনিক গণমাধ্যমের কথা উল্লেখ করা হয় তাহলে ইউরোপেই প্রথম জন্ম হয়। তবে এও ঠিক যে, বিশ্বে সংবাদপত্রের ধারণা প্রাচীন। রোমানদের থেকেই আসে ৫৯ খ্রিস্টাব্দে পূর্বে অ্যাক্টা দুইমা (Acta Diuma) ছিল বিশ্বের প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে যার নাম ছিল ‘লা গেজেট’ (La Gazette)! এরপর ধীরে ধীরে সংবাদপত্রের প্রচলন হয়। সংবাদপত্রের হাত ধরেই বিশ্বে ম্যাগাজিন বা মলিক পত্রিকার সূচনা হয়। এগুলি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর প্রকাশিত হত যার জন্য এগুলিকে পিরিওডিকলস্ বলা হত। বিশ্বের প্রথম Magazine হল ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত জার্মানির একটি দার্শনিক Magazine যার নাম মেনাটস, আন-উরেদুনজেন, ইংবিউলিকে তবে আধুনিক Magazine প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে “The Gentle Man’s Magazine”। ধীরে ধীরে আধুনিক যন্ত্রপাতির আবিষ্কার হলে সংবাদপত্র ও Magazine-এর জায়গা টেলিভিশন রেডিও ইত্যাদি বৈদ্যুতিন যন্ত্র জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রথম রেডিও সম্প্রচার শুরু হয় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ১৪ই ডিসেম্বর। এর মূল উদ্যোক্তা রেজিন্যাল্ড.এ. ফেসেনডেন-যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানুষের মধ্যে গান ও নানা রকম বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের সম্প্রচার করা। এরপর রেডিও দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর টেলিভিশন গণমাধ্যমে দুনিয়ায় পা রাখলে সমস্ত দিকে এক নতুন আলোড়নের সৃষ্টি করে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ১৭ই সেপ্টেম্বর “The Queen’s Messenger” নামক একটি একাঙ্ক নাটকের সম্প্রচারের মাধ্যমে বিশ্বে প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয়। তবে যুগের গতিতে গণমাধ্যম হিসেবে “Social Media” প্রতিপত্তি বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়েছে। Facebook, Twitter, Snapchat, Instagnam প্রকৃতি সোস্যাল মিডিয়া সাইডগুলি বর্তমানে দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এগুলি যে শুধু মানুষকে যোগাযোগ সাহায্য করছে এমন নয় এগুলি কখনও-কখনও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধেও জনমতকে ঐক্যবদ্ধ করছে।

গণমাধ্যম ও বর্তমান সমাজ: গণমাধ্যমগুলি বর্তমান সমাজকে একে অপরের কাছে এনে দিয়েছে, মানুষ আজ নিজের ঘরে বসেই জানতে পারছে সারা বিশ্বের খবর। গণমাধ্যম মানুষকে আরও বেশি সামাজিকতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। মানুষের জ্ঞানের পরিধিকে বাড়িয়ে যা মানুষের অজ্ঞানতা ও অনগ্রসরতা অনেকটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছে। গণমাধ্যমের ব্যবহার: গণমাধ্যম যেমন মানুষকে আরও বেশি সামাজিক করে তুলেছে তেমনি মানুয়ের মধ্যে একাকিত্ব সৃষ্টি করেছে। মানুষ সামাজিক জীব হলেও বাস্তব জীবনেও সে একা। গণমাধ্যম মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে গিয়ে বরং অনেকটা কমিয়েই দিয়েছে যার ফলে মানুষ সমাজে নানারকম বিকৃতি দেখা দিচ্ছে। এর প্রভাব বোধহয় সবচেয়ে বেশি দেখা দিয়েছে যুবক-যুবতীদের ওপর, কারণ বর্তমানে এই সম্প্রদায়ই গণমাধ্যম বা Social Media জ্বরে আক্রান্ত। তারা বাস্তব জীবনের বাইরে বৈদ্যুতিন যন্ত্রের স্বর্গরাজ্যের বিচরণ করতেই বেশি ভালোবাসে যার ফলে তারা খুব সহজেই একাকিত্ব, মানসিক অবসাদ, ওবেসিটি ইত্যাদি আধুনিক রোগে আক্রান্ত। যার ফলে বর্তমানে যুবসমাজের মধ্যে আত্মহত্যাপ্রবণতা হিংসা-দ্বেষ অপরাধ প্রবণতা ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজকে এক বিপরীতমুখী রাস্তায় নিয়ে চলেছে, তাই গণমাধ্যমের এই কুপ্রভাব থেকে বর্তমান যুবসম্প্রদায়কে উদ্ধার করা একধরনের অসাধ্য কাজ।

তবে একথাও ঠিক যে মানুষ চাইলেই গণমাধ্যমকে ভালোদিকে ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু মানুষের অত্যধিক ভোগবিলাস ও আরও উন্নত জীবনযাপনের উদ্দেশ্য সমাজকে দায়ীভূত করছে। এই সম্পর্কে আরও বলা যেতে পারে যে গণমাধ্যমগুলিকে নিরপেক্ষ এবং সুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক হয়ে উঠতে হবে। নয়তো এই সমাজের ধ্বংস অনিবার্য।

গণমাধ্যমের প্রভাব: গণমাধ্যম যে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এযাবৎ কালে গণমাধ্যম যে সমাজের ওপর গভীর প্রভাব সৃষ্টি করেছে সেই নিদর্শন বিশ্ববাসী বারে বারে দেখেছে। বলতে গেলে আধুনিক সমাজে ঐক্যচেতনা শুভবুদ্ধি উন্নয়ন সৃষ্টিশীল মানসিকতা গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিহার্য, এমনকি রাজনৈতিক ও সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সৃষ্ট তথ্য প্রদানের মাধ্যমে মানুষের মনে প্রতিবাদস্পৃহাকে জাগিয়ে তোলে গণমাধ্যম যে বর্তমান যুগে কতটা সক্রিয় তা আমরা বিশ্বে নানাক্ষেত্রে দেখেছি। প্রসভূত উল্লেখ্য তদানীন্তন কালে মিশরে স্বৈরাচারী শাসনের পতনকালে গণমাধ্যম-ই মানুষের মনে সত্য উপলব্ধি ও প্রতিবাদস্পৃহাকে জাগিয়ে তুলেছিল। শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন নয় গণমাধ্যমের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বিশ্বে এখনও অবধি বহু সামাজিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। বর্তমানে শুধু টেলিভিশন বা রেডিও নয়, সোস্যাল মিডিয়া সাইডগুলিও অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষেকে ঐক্যবদ্ধ করছে এবং এই সাইডগুলি আজকাল ক্ষোভ প্রকাশের অন্যতম হাতিয়ার। তবে এই প্রতিবাদ যেন কখনোই কুরুচিকর ও অশালীনতায় পরিণত না হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রতিবাদের ভাষা তার মাত্রা হারিয়েছে যা জনমানসে কুপ্রভাব বিস্তার করেছে। যা অনেক ক্ষেত্রে ভুল ধারণার বিস্তার ঘটায় আবার অনেকে এও বলে থাকেন যে গণমাধ্যমগুলি প্রকৃত নিরপেক্ষতা-দোষে দুষ্ট। তারা এই অভিযোগ আনেন যে গণমাধ্যম প্রকৃত সত্য ঘটনাকে নিজ কল্পনার আড়ালে মুড়ে বিকৃত ভাবে প্রচারিত করে। তবে একথা মানতে অনেকে রাজি নয়।

ভারতের গণমাধ্যমের প্রসার: ভারতে টেলিভিশন রেডিও ইত্যাদির প্রচার অনেক। দেরিতে শুরু হয়েছে বলা যেতে পারে। তবে একবিংশ শতকের গোড়ায় দাঁড়িয়ে ভারতে। যে গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে এক নিঃশব্দ বিপ্লব এসেছে তা অস্বীকার করা যায় না। ভারত তাই আজ “ডিজিটাল ইন্ডিয়া”-র স্বপ্ন দেখে। ভারতে আজ ঘরে ঘরে প্রায় টেলিভিশন এবং সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারেও ভারত বিশ্বের অন্যান্য দেশকে যে হারিয়ে দিয়েছে তা সাম্প্রতিক সমীক্ষাই বলছে। ভারতে অনেকক্ষেত্রে এই গণমাধ্যমের বিপ্লব যে অনেকটাই শহরকেন্দ্রিক এবং সচ্ছল মানুষদের মধ্যে আটকে তা অনেকেই স্বীকার করেছেন। গণমাধ্যম ও গ্রামীণ সমাজঃ আজকের মতে গ্রামীণ ভারতীয়রা এই কুপ্রভাব থেকে অনেকটাই দূরে। ভারতের ক্ষেত্রে যেমন দেখা দিয়েছে তেমনি বর্তমান সমাজের ওপর এর কুপ্রভাবও অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে যুবক এবং যুবতীদের ওপর। তারা তাদের নিজেদের কলেজে বিভিন্ন আন্দোলন করছে, এসমস্ত কিছু দেখা যাচ্ছে কলকাতা ইউনিভার্সিটিসহ অন্যান্য কলেজেও আমরা ঘরে বসে দেশবিদেশের খবর পাচ্ছি ঠিকই, এই গণমাধ্যমের ফলেই আমরা আজ ভুলে গেছি সামাজিকতা। মানুষ ধীরে ধীরে এক ভোগবিলাস আড়ম্বর সর্বস্ব জীবনের পথে পা বাড়াচ্ছে, তাই মানুষ আজ ভুলে যাচ্ছে বিকেলের আড্ডা, সকালের প্রাতঃভ্রমণ, খেলার মাঠ, বন্ধুমহল। আজ সে নিজেকে বন্দি করেছে চার দেয়ালের কামরার ভিতরে। যা সামাজিক অপরাধ ক্রমশ বাড়িয়ে দিয়েছে।

উপসংহারঃ সমালোচনা সত্ত্বেও একথা ঠিক যে আধুনিক জনজীবন গণমাধ্যম ছাড়া অসম্পূর্ণ। আজ ব্যক্তি গণমাধ্যমের প্রভাবে যথেষ্ট প্রভাবিত। তবে এদিকেও খেয়াল রাখা দরকার যে গণমাধ্যম যেন কখনোই স্বার্থান্বেষী মানুষের হাতের মুঠোর পরিচালিত না হয়। যাতে এটা কখনোই কুরুচিকর ও পক্ষপাতদোষে দুষ্ট না হয়ে পড়ে। তাই গণমাধ্যমের মতো শক্তিশালী হাতিয়ারকে অবশ্যই যথেষ্ট যত্ন ও সচেতনতার সাথে ব্যবহার করা উচিত, নয়তো এটি সমাজের ওপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

Leave a Comment