বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ – প্রবন্ধ রচনা

ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মান্ধতার বুকে শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মপ্রাণতার দ্যুতি আর বিবেকানন্দ তাঁরই মন্ত্রকণ্ঠ বাণীপ্রচারক। একজন স্নিগ্ধ সূত্র অন্যজন সরব ভাষ্য। মহাপুরুষের আভিধানিক অর্থ অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন সাধুপুরুষ। এ হিসাবে স্বামী বিবেকানন্দ অতীতরূপে একজন মহাপুরুষ, মাত্র ঊনচল্লিশ বছরের স্বল্প জীবনে ভারত তথা য়ুরোপ আমেরিকাতে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর বেদান্তের বাণী শুনিয়ে, যার জন্য বিদেশে খ্যাত ছিলেন ‘Cyclonic monk’ হিসাবে, তাঁর তেজ, তাঁর মহিমা অবিস্মরণীয়। তথাকথিত সাধুজন সুলভ অলৌকিকতার প্রতি বিবেকান্দের কোনো আগ্রহ ছিল না, বরং তা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, বাস্তব লৌকিক জগতের মধ্যে পীড়িত ও লাঞ্ছিত মানবাত্মার সেবাতেই জীবন্ত ঈশ্বরের সাধনা করেছেন।

বাল্যজীবন: স্বামী বিবেকানন্দের সংসারাশ্রমের নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। জন্ম ১৮৬৩ সালের ১২ই জানুয়ারী কলকাতার সিমলাপাড়ায়। জন্মদাতা বিশ্বনাথ দত্ত, জন্মদাত্রী ভুবনেশ্বরী দেবী। এঁর ডাকনাম ছিল ‘বীরেশ্বর’ বা ‘বিলে’।

শিক্ষা জীবন: মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশানে পড়তেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, বুদ্ধিমান আর পাঠানুরাগী। ছাত্রাবস্থা থেকেই অসাধারণ আত্মসম্মানবোধের জন্য তিনি বিদ্যাসাগর মশাই-এরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শৈশবেই নরেন্দ্রনাথের মনে ধর্মচেতনার সঞ্চার হয়েছিল। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন। এইসময়েই পাশ্চাত্য দর্শন ও ব্রাহ্মধর্মের সংস্পর্শে এসে ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠেন। ঈশ্বরে আসক্তি, ধর্মে বিশ্বাস নরেন্দ্রের জন্মগত। কিন্তু পাশ্চাত্যদর্শন পড়ে ধীরে ধীরে তিনি সংশয়বাদী হয়ে উঠতে লাগলেন। পশ্চিমী যুক্তিবাদ তাঁর ভক্তিবিশ্বাসের ভূমিটিকে ক্রমে আঘাত করতে লাগল। নরেন্দ্র নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকলেন। অথচ বিশ্বচরাচরের পরমতম সত্যকে জানার জন্যও তিনি আকুল। পরে দক্ষিণেশ্বরের পরমপুরুষ শ্রী রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসে তাঁর ঈশ্বর জিজ্ঞাসা তৃপ্ত হয়, এক নতুন জীবনের সন্ধান লাভ করেন। এই আকুতিই তাঁকে টেনে নিয়ে যায় সন্ন্যাসধর্মে। ১৮৮৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের পর বরাহনগরে রামকৃষ্ণ মঠ স্থাপিত হলে নরেন্দ্রনাথ সেই মঠের সন্ন্যাসী সংঘের পরিচালক হন এবং নতুন নাম গ্রহণ করেন স্বামী বিবেকানন্দ-এই নামে পরবর্তীতে জগদ্বিখ্যাত হন তিনি।

ভারত পরিক্রমণ: নরেন্দ্রনাথ অন্তরে অন্তরে নির্লিপ্ত পুরুষ ছিলেন। কোনরকম বন্ধন তিনি দীর্ঘকাল সহ্য করতে পারতেন না। এই অসহিষুতা থেকে লাঠি আর কমন্ডলু হাতে নিয়ে ভারতভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন। আসমুদ্রহিমাচল ঘুরে বেড়ালেন পায়ে হেঁটে। সনাতন ভারতবর্ষকে তিনি চাক্ষুষ করলেন, ভারতভূমির অন্তঃপ্রকৃতি ও বাহ্যিক রূপটির সর্বাঙ্গীণ পরিচয় পেলেন-নিজের সমস্ত সত্তা দিয়ে ভারতজননীকে যেন স্পর্শ করলেন। দেখলেন, ভাষায় আচারে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিভিন্নতা থাকলেও ভারতবাসীর সংস্কৃতি একইসূত্রে গাঁথা। তাঁর মনে সবচেয়ে বেশী আঘাত হানল দেশের বেশিরভাগ মানুষের অসহনীয় দারিদ্র। ভারতের জনসাধারণের মধ্যে ধর্মবোধের অভাব না থাকলেও তা তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এই দরিদ্র ভারতবাসী এতটুকু সহানুভূতি পায় না, মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, শিক্ষার আলোকের অভাবে অজ্ঞতার ও মূঢ়তার মধ্যে পর্যবসিত। নরেন্দ্রনাথ তাঁর গুরুর উক্তি ‘খালি পেটে ধর্ম হয় না’ কে মনে রেখে যে নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করলেন তাঁর মূল ও প্রধানতম লক্ষ্য জনসেবা। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে পরিব্রাজকের উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষিত হল, ‘হে ভারত ভুলিও না-নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর, তোমার রক্ত, তোমার ভাই।’

বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগদান: ১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকার চিকাগো শহরে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনের যোগ দিতে গিয়ে অভূতপূর্ব ভাষণে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেন। বেদান্তের মূল সত্যগুলি তুলে ধরেন ঐ বক্তৃতায়। ১১ই সেপ্টেম্বর বিপুল দর্শকমণ্ডলীর সামনে তিনি মন্ত্রচালিতের মতো বলে ওঠেন, ‘শোনো আমেরিকাবাসী ভাইবোনেরা।’ অনাহৃত সন্ন্যাসীর কণ্ঠে আত্মীয়তার কোমল স্পর্শে মন্ত্রমুগ্ধ অগণিত অধিবাসী বিবেকানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ভারতের সেবায় নিবেদিত প্রাণা মিস্ মার্গারেট নোবল-ভগিনী নিবেদিতা হয়ে বিবেকানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

বেলুর মঠ প্রতিষ্ঠা: অতিরিক্ত পরিশ্রমে স্বামীজির শরীর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল। এরপর ইওরোপে কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে ভারতবর্ষে ফেরার পথে ১৮৯৭ সালে কলম্বো ঘুরে ফিরলেন। ভারতে ফেরার পর কলকাতানগরী তাঁকে শ্রেষ্ঠ জাতীয় নেতা হিসাবে মানপত্র দিয়ে অভিনন্দিত করল। এরপর ‘বেলুর মঠ’ প্রতিষ্ঠা বিবেকানন্দের এক বিরাট কীর্তি। বেলুড়মঠকে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে।

মহাপ্রয়াণ: ধীরে ধীরে বিবেকানন্দের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে লাগল। বিশ্রাম না নিয়ে দর্শনার্থীদের সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত থাকতেন। ফলে স্বামীজির ভগ্ন স্বাস্থ্য আরো করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে গেল। ১৯১২ সালের ৪ঠা জুলাই, মহাপ্রেমিক সন্ন্যাসী. বিবেকানন্দ অমর্ত্যলোকের সন্ধানে চললেন। স্বামীজির চিন্তা-চেতনা বর্তমান জীবনের প্রেক্ষাপটে এখনও সমভাবে প্রযোজ্য।

Leave a Comment