ভূমিকা: ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’-অশেষ আনন্দ-পথের আকাঙ্ক্ষা যতই থাকুক না কেন তবু তা একসময় শেষ হয়। প্রকৃতির সেই অমোঘ নিয়মের অনুসারী হয়ে গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি ‘২২ মঙ্গল-সন্ধ্যায় ৭-২০ মিনিটে চিরছুটিতে চলে গেলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ঘুম ঘুম চাঁদ আর ঝিকিমিকি তারার নীচে পড়ে রইল তাঁর রেখে যাওয়া অমূল্য সব আনন্দ ঝরণার ধারা। অস্তরাগের একমুঠোর নরম আলো এক চির উজ্জ্বল ইন্দ্রধনু হয়ে বিছিয়ে গেল বাংলা গানের ভাবী কালের গায়ে। আধুনিক বাংলা গান সাবালক হয়েছিল যাঁদের অনিন্দ্যসুন্দর কণ্ঠে, তাঁদের শেষ প্রতিনিধিত্ব অতীত হয়ে গেলেন কালের গর্ভে।
জন্মপরিচয় ও সংগীত শিক্ষা: ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা অক্টোবর ঢাকুরিয়ার ব্যানার্জি পাড়ায় জন্ম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। পিতা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও মাতা হেমপ্রভার ছয় সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। শৈশবে মায়ের কণ্ঠে নিধুবাবুর টপ্পা গান শুনে সংগীতের প্রতি আকর্ষণ জন্মায় সন্ধ্যার। জন্মের পর এই একরত্তি মেয়েকে ডাকা হতো ‘দুলদুল’ নামে। পরে ‘সন্ধ্যা’ নামটি দিয়েছিলেন তাঁর খুড়তুতো দিদি অপর্ণা। সন্ধ্যার প্রথাগত প্রাথমিক পাঠ শুরু হয় ঢাকুরিয়া বালিকা বিদ্যালয়ে। তারপর সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন বিনোদিনী গার্লস হাইস্কুলে। কিন্তু বেশি দিন তিনি বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষায় এগিয়ে যাননি। অচিরেই সংগীতকেই তিনি জীবনের ধ্রুবতারা হিসেবে গ্রহণ করেন।
সংগীত জীবনে প্রবেশ: সংগীতের প্রথম পাঠ তাঁর পিতার কাছে হলেও প্রথাগত গানে হাতে খড়ি সন্তোষ বসু মল্লিকের কাছে। এ বিষয়ে দাদা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অবদানও অনেক। তিনি ছোট বোন সন্ধ্যাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন সংগীতাচার্য যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। এইভাবে মার্গ সংগীতের তালিমের সূত্র ধরে অল্প দিনের মধ্যেই বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স, অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে গুণীজনদের নজরে আসেন। মাত্র ১৪ বৎসর বয়সে ১৯৪৫ সালে প্রথম তাঁর বেসিক গানের রেকর্ড হয়। ১৯৫৮ সালে ছায়াছবিতে গাওয়ার ডাক পান। ছবি ‘অল্গুনগড়’, সঙ্গীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল। এবং পরের ছবি-‘সমাপিকা’তে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সংগীত পরিচালনায় গান রেকর্ড করেন। ঐ সালেই তাঁর তিনটি বেসিক রেকর্ড। বাকিটা ইতিহাস। ঐ সময় ‘অভিমান’ ছবির গান গাওয়ার সূত্রে প্রথম আলাপ হয় গীতিকার শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে। পরে ১৯৬৬ সালের ১০ই মার্চ তাঁরই সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন সন্ধ্যা। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সন্তোষ কুমার বসু, এ টি কানন, চিন্ময় লাহিড়ী প্রমুখের কাছে। পরে দাদা তাঁকে পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের কাছে নিয়ে যান। পরে তাঁর সুপারিশে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের কাছে সন্ধ্যা প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। উপমহাদেশের তৎকালীন কিংবদন্তি এই সংগীতগুরুর মৃত্যুর পরও অবশেষে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে শচীন দেব বর্মণের সূত্রে তিনি প্রবেশ করলেন মুম্বাইয়ের ফিল্মি
গানের পাঠ অব্যাহত রেখেছেন তাঁর পুত্র উস্তাদ মুনাবর আলির কাছে। সংগীত জগতে। শুরু হল সংগীত জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। হিন্দি ছবিতে প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগ এল অনিল বিশ্বাসের হাত ধরে। তাঁর সুরে ‘তারানা’ ছবির জন্য গাইলেন সন্ধ্যা। ঐ একই ছবিতে তাঁর সঙ্গে গাইলেন লতা মঙ্গেশকরও। এরপর তিনি আরও অনেক হিন্দি গান রেকর্ড করেছেন। মুম্বাইতে মোট ১৭টি হিন্দি ছবিতে তাঁর গানের প্লেব্যাক পাওয়া যায়। এরপর ১৯৫২ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। কলকাতায় ফেরার পরও তিনি মুম্বাইতে কাজ করেছেন। তবে মূলত তিনি আঁকড়ে ধরলেন বাংলা গানকেই। দীর্ঘ সংগীত জীবনে নানা ধরনের গান গেয়েছেন তিনি। রবীন্দ্র সমসাময়িক কালের কাব্যগীতির রেকর্ড করেছেন, তেমনি ভজনে অন্য মাত্রা এনেছেন। বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে শ্রোতারা আলাদা আলাদা কনসার্টে-তাঁর গলায় শুনেছেন উচ্চাঙ্গ সংগীত এবং আধুনিক বাংলা গান। তবে শ্রোতাদের মনে তাঁর চিরকালীন আসন পাতা আছে বাংলা বেসিক রেকর্ড এবং চলচ্চিত্রের জন্য তাঁর অবিস্মরণীয় সব গানের জমিতেই। কলকাতা ও মুম্বাইয়ের বহু সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। যাঁদের মধ্যে শচীন দেব বর্মণ, অনিল বাগচি, মদনমোহন, সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, রবীন চট্টোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম অন্যতম। তবে ইতিহাস তৈরি হয়েছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর জুটিতে। ছায়াছবিতে উত্তম-সুচিত্রা ও হেমন্ত-সন্ধ্যা জুটি পরস্পর পরিপুরক হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সন্ধ্যা অবতীর্ণ হয়েছেন অন্য ভূমিকায়। শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াতে গানকেই মাধ্যম করেন তিনি। সমর দাস ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াসে কলকাতায় গড়ে উঠেছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র’।’
সম্মাননা ও পুরস্কার প্রাপ্তি: দীর্ঘ সংগীত জীবনে তিনি পেয়েছেন বহু সম্মান ও পুরস্কার। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলি হল-বঙ্গবিভূষণ, ‘এইচ এম ভির গোল্ডডিস্ক ও প্লাটিনাম ডিস্ক, ইন্দিরা গান্ধি স্মৃতি পুরস্কার, রাজ্য সংগীত আকাদেমির আলাউদ্দিন পুরস্কার, বর্ধমান, রবীন্দ্রভারতী, যাদবপুর, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে সাম্মানিক ডিলিট ইত্যাদি। এ ছাড়া নিউইয়র্কে আয়োজিত নর্থ আমেরিকান কালচারাল কনফারেন্সের মঞ্চে উপস্থিত থেকে জ্যোতি বসু ও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় সম্মানিত করেছেন সন্ধ্যাকে। শেষ জীবনে কেন্দ্রীয় সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার সঙ্গত কারণেই প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
উপসংহার: পরিপূর্ণ পরিণত বয়সেই তাঁর মৃত্যু হলেও বাংলা গানের জগতের এক অপার শূন্যতা তৈরি করে দিয়ে গেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাংলা তথা ভারতীয় সংগীতকাশের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক নিবে গেল বাংলার মা সরস্বতীর বিদায়ে।