লীলা মজুমদার সাহিত্য অবদান প্রজেক্ট

আজকের পোস্টে ক্লাস ১২ এর জন্য ‘নির্বাচিত সাহিত্যিকের সাহিত্য অবদান সম্পর্কিত প্রকল্প নির্মাণ লীলা মজুমদার’ প্রজেক্টটি সবার সাথে শেয়ার করা হল। যেটি শিক্ষার্থীদের দ্বাদশ শ্রেণীর প্রজেক্ট তৈরিতে সহায়তা করবে।

নির্বাচিত সাহিত্যিকের সাহিত্য অবদান সম্পর্কিত প্রকল্প নির্মাণ লীলা মজুমদার

বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অঙ্গ হল শিশু ও কিশোর সাহিত্য। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির হাত ধরে মননশীল সাহিত্য, গান এবং নাটক যখন উৎকর্ষের চরম সীমায় পৌঁছেছিল, সেসময় রায়চৌধুরী পরিবার বাংলায় শিশু ও কিশোর সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও সুকুমার রায় সাহিত্যের যে ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, সেই ধারার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন লীলা মজুমদার।

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফ্রেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন লীলা মজুমদার। বাবা প্রমদারঞ্জন রায় ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোটো ভাই। তিনি জরিপ বিভাগে কাজের সুবাদে বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন এবং সেই বিবরণ ছোটোদের মতো করে লিখতেন। এই লেখাগুলির সংকলন ‘বনের খবর’ নামে পরিচিত। মা সুরমা দেবীও উপেন্দ্রকিশোরের কাছের মানুষ। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লীলা মজুমদারের বাল্যজীবন কেটেছে শিলংয়ে। পড়তেন লরেটো কনভেন্টে। এরপর বাবা বদলি হয়ে কলকাতায় এলে তিনি সেন্ট জন ডায়োসেশান স্কুলে ভরতি হন। এই স্কুল থেকেই ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ডায়োসেশন কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় দ্বিতীয় এবং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি অনার্সে প্রথম স্থান লাভ করেন। ইংরেজি সাহিত্যে অসাধারণ মেধাবী এই লেখিকা এমএ পরীক্ষায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ের সাথে যুগ্মভাবে প্রথম সস্থান অর্জন করেন।

তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে দার্জিলিং-এর মহারানি গার্লস স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে। তারপর রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরের আমন্ত্রণে শিক্ষকতা করেন শান্তিনিকেতনেও। কিন্তু এক বছর পর শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায় এবং আশুতোষ কলেজের মহিলা বিভাগে পড়ানো শুরু করেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ডা. সুধীরকুমার মজুমদারের সাথে বিবাহসূত্রে আবন্ধ হন। আকাশবাণীতে চাকরি করার সল্যে সঙ্গোই তিনি ঐতিহ্যবাহী ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজও করেছেন দীর্ঘদিন। পত্রিকায় লেখা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জোর দিতেন লেখার সাহিত্যমূল্য, রস, শিশুমানসিকতার উপযোগী কি না ইত্যাদি বিষয়ের উপর। তবে বাঙালির কাছে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত শিশু ও কিশোর সাহিত্যের লেখিকা হিসেবে। লীলা

মজুমদারের প্রথম রচনা প্রকাশিত হয় মাত্র বারো বছর বয়সে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় নিজের আঁকা ছবিসহ প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প ‘লক্ষ্মী ছেলে’। তাঁর প্রথম বই ‘বদ্যিনাথের বড়ি’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে। এরপর একে একে লিখেছেন ছোটোগল্প, শিশুনাট্য, উপন্যাস, আত্মজীবনী, জীবনী, অনুবাদ সাহিত্য ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। ‘সন্দেশ’ ছাড়াও ‘রামধনু’, ‘মৌচাক’, ‘শিশুসাথী’ ইত্যাদি পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখিকার সাহিত্যসম্ভার প্রায় ১১১টিরও বেশি গ্রন্থ, ছোটোগল্পের সংকলন, ৭টি অনুবাদ। গ্রন্থ, অন্য লেখকের সাথে যুগ্মভাবে লেখা প্রায় ৩টি বই ইত্যাদি অনেক রচনায় সমৃদ্ধ।

তবে তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে একজন শিশুসাহিত্যিক। তাঁর নিজের ভাষায়- “সমস্ত মন পড়ে থাকে ছোটদের জন্য লেখার দিকে। জানি ও পথে কেউ নাম পায় না, কড়ি পায় না, পুরস্কার পায় না। তবে এ-ও জানি তাতে কিছু এসে যায় না। ঐখানেই আমার আসল কাজ।” বড়োদের জন্য লিখলেও তিনি বিশ্বাস করতেন- “বড়োদের জন্য লেখা আমার বিলাস, ছোটোদের জন্য লেখা আমার জীবন।”

শিশুসাহিত্য: লীলা মজুমদারের সৃষ্টি শিশু ও কিশোর পাঠ্যগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ছোটোগল্পগুলির। তাঁর লেখা ছোটো গল্পগুলি নানান বৈচিত্র্যে ভরা, কখনও তার বিষয় ভূত, কখনও পশুপাখি, কখনও রহস্যরোমাঞ্চ, আবার কখনও বা উপকথা। আর এগুলির মধ্যে সম্ভবত জনপ্রিয়তার নিরিখে এগিয়ে রয়েছে ভূতের গল্পগুলি।

বিধাতার মঙ্গঙ্গলবিধানে লেখিকার পরিপূর্ণ আস্থা, আর তাই তাঁর সব ভূতেরাই চেহারায় নিপাট ভালোমানুষ। কথাও বলে মানুষের মতো স্বাভাবিক ভাষাতে। তারা মানুষের বন্ধু। মানুষের কোনো অনিষ্ট করে না, উলটে উপকার করে অনেক ক্ষেত্রে। ‘পেনেটিতে’, ‘আহিরিটোলার বাড়ি’, ‘অহিদিদির বন্ধুরা’, ‘তেপান্তরের পারের বাড়ি’, ‘ভূতুড়ে গল্প’, ‘কলম সরদার’, ‘ফ্যান্টাস্টিক’, ‘ভয়’, ‘তোজো’ ইত্যাদি প্রায় বিয়াল্লিশটি যমে কমবেশি এই বৈশিষ্ট্যই চোখে পড়ে। শুধু ভূত নয়, রয়েছে ভূতিনীরাও। ‘রাত্রে’, ‘আলো-ছায়া’, ‘সোনালি-রূপালি’ গল্পের নারী ভূতগুলির চাহিদাও জীবিত নারীর মতোই অর্থাৎ গয়নাগাটিকে কেন্দ্র করে। লীলা মজুমদারের ভূতের গল্পের অন্যতম উপাদান হল কৌতুকরস। গল্পে ভুত নিজেই বলে- ‘ভূত। এ বাড়িতে আবার ভূত কোথায়?’ তাঁর গল্পগুলি দৈনন্দিনতার স্বাভাবিকতায় মোড়া, সেখানে কোথাও ‘খেয়াল রস’ চোখে পড়ে না।

শুধু ভূত নয়, পশুপাখিদের নিয়েও তিনি গড়ে তুলেছেন তাঁর সাহিত্যের সংসার। বন্যপশুকেন্দ্রিক গল্পগুলিকে লীলা মজুমদার সাজিয়েছেন অপরূপ অরণ্যসৌন্দর্যের সম্ভারে। বন্যপশুর স্বাধীনতাকে স্বর্ণ হতে দেখলেই তিনি বিচলিত হয়েছেন। বন্যেরা বনে সুন্দর-এই কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন তিনি। তাঁর গল্পে হাতি, বাঘ, বিড়াল, কুকুর, মাছ, পায়রা, বনবিড়াল, হনুমান সবাইকে জায়গা করে দিয়েছেন। ‘মাস্তান’, ‘হাতির ব্যাপার’, ‘বড়ো জ্যাঠামশায়ের গল্প’, ‘বুঁদপুরের বাঘ’, ‘আনন্দ জগৎ’, টাইগার’, ‘মুনি’ ইত্যাদি এই ধারার গল্পের মধ্যে অন্যতম। কেবলমাত্র বিড়ালদের নিয়েই লেখা- ‘বেড়ালের বই’।

রহস্যরোমাঞ্চ এবং উপকথার নানান গল্পেও লেখিকা সমান স্বাচ্ছন্দ। একদিকে যেমন- ‘ডিটেকটিভ’, ‘দ্বিতীয় টিকটিকি’ লিখেছেন, তেমনই আবার লিখেছেন সিকিমের উপকথা- ‘আদিপুরুষের দেশে’। রূপকথা এবং উপকথার পার্থক্য প্রসঙ্গে লেখিকা সুন্দরভাবে বলেছেন- রূপকথা হল ছেলে-ভুলানো পরীদের গল্প, ইচ্ছা হলে আজও তৈরি করা যায়। উপকথা লোকের মুখে মুখে যেন আপনা থেকে গড়ে ওঠে। তাদের মূল থাকে অতীতে। রূপকথা হল অন্যদের গল্প আর উপকথা আমাদের নিজেদের গল্প। আমাদের দেশের মাটি-জল-হাওয়া দিয়ে গড়া।” লীলা মজুমদার বিভিন্ন দেশের উপকথা সংগ্রহ ও অনুবাদ করেছেন। কল্পবিজ্ঞানও বাদ যায়নি, ‘বাতাসবাড়ি’ তার অন্যতম উদাহরণ। এ ছাড়াও ‘কাগ নয়’, ‘জাদুবিদ্যা’, ‘গুম্ফা’ ইত্যাদিও ছোটোগল্প হিসেবে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। লিখেছেন যুক্তাক্ষর বর্জিত গল্পসংগ্রহ ‘জানোয়ার’।

ছোটোগল্প ব্যতীত লীলা মজুমদারের শিশু ও কিশোর সাহিত্য যে রচনাগুলি ছাড়া অসম্পূর্ণ, সেগুলির মধ্যে-‘দিন দুপুরে’, ‘টং লিং’, ‘মাকু’, ‘নেপোর বই’, ‘হলদে পাখির পালক’, ‘গুপীর গুপ্তখাতা’, ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’, ‘মহাভারতের গল্প’ ইত্যাদি আরও অনেক চেনাজানা নাম। টং লিং-এর পেরিস্তান, মাকু-সোনা-টিয়া, বোগি-ঝগড়, গুপী, ঘোতনের সাথে জড়িয়ে অগণিত বাঙালির শৈশবকাল। ‘হলদে পাখির পালক’ হল পিটারপ্যানের অবাক করা সেই পৃথিবীর মতো, যেখানে সন্দিগ্ধদের প্রবেশ নিষেধ। ‘গুপীর গুপ্তখাতা’ রহস্যের মোড়কে লেখা অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মজা। কজন ভুলতে পেরেছে সেই বর্মিবাক্সের মালিক পদিপিসিকে, যার চোখের চাহনিতে ভয় পেয়ে গোরু তিনদিন ধরে দুধের বদলে দই দেয়।

শিশুনাট্য লেখার ক্ষেত্রে লীলার অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর বড়দা সুকুমার রায়। লেখিকার প্রথম এবং সবথেকে বিখ্যাত নাটক হল-‘বকবধ পালা’। নাটকটি যাত্রার মতো করে লেখা। এ ছাড়া ‘আলো’, ‘লঙ্কা দহন পালা’, ‘থরহরি সংবাদ’, ‘নোহর বিপত্তি’, ‘রূপ প্রতিযোগিতা’ ইত্যাদিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। শিশুনাট্যে তিনি বীভৎসরস পরিহার করার চেষ্টা করেছেন, এনেছেন হাস্যরস। যেমন, ঘটোৎকচের বর্ণনা দিতে গিয়ে হিড়িম্বা বলে-“তা এই তাল গাছটি পরমাণ হবে বই কি। আর দেখতে যেন সাক্ষাৎ কার্তিক ঠাকুরটি। ইয়া ছাতি, যেন একটা বিরাট কালো পাহাড়। ইয়া মুখখানিতে কেমন সুন্দর তামাটে রঙের নৌকার মত ঠোঁট দুখানি। আর প্যাখনা-পনা কান দুটি মাথার দুপাশে এমনি করে উচিয়ে রেখেছে। আর মাথাটিও কী সুন্দর মোলায়েম চিক চিক করছে, চুল টুলের বালাই নেই।” এ ছাড়া ছোটোদের জন্য অনুবাদ করেছেন জনাথন সুইফটের ‘গালিভারস ট্রাভেলস’।

শিশুসাহিত্য রচনার পাশাপাশি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী লেখার ক্ষেত্রেও লীলা মজুমদার তাঁর প্রতিভার সাক্ষ্য রেখেছেন। তাঁর লেখা প্রথম জীবনীগ্রন্থটি হল ‘উপেন্দ্রকিশোর’। রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা নিয়ে লেখেন ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি’। দুটি লেখাই ছিল ইংরেজিতে। ‘অবনীন্দ্রনাথ’ নামক গ্রন্থটি অবনঠাকুরকে কেন্দ্র করে লীলা মজুমদারের বক্তৃতা এবং প্রবন্ধের সংকলন। তবে ‘সুকুমার’ সম্ভবত লেখিকার সবথেকে সুলিখিত জীবনীগ্রন্থ। এই গ্রন্থগুলির ভাষা এবং রচনাভঙ্গি এত সহজসরল যে, শিশু-কিশোরদের পাশাপাশি তা বড়োদেরও সমানভাবে আকর্ষণ করে।

অন্যান্য রচনা: সারাজীবন ধরে লীলা মজুমদার অনেক লিখেছেন, যার বেশিরভাগই ছোটোদের জন্য। তাই তাঁর পরিচিতিও শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই। তবে বড়োদের জন্যও তাঁর কিছু কিছু লেখা রয়েছে। ‘শ্রীমতি’ নামে মেয়েদের এক মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম বড়োদের উপন্যাস-যার নামও ছিল ‘শ্রীমতী’। এরপর একে একে লেখেন-‘জোনাকি’, ‘মণিকুন্তলা’, ‘চীনে লুণ্ঠন’, ‘ঝাঁপতাল’, ‘নাটঘর’, ‘আয়না’, ‘যাত্রী’ ইত্যাদি উপন্যাস। লীলা মজুমদারের উপন্যাসগুলি সবকটি প্রায় নারীকেন্দ্রিক। তাঁর নায়িকারা প্রত্যেকেই স্বাবলম্বী এবং নানা পেশায় স্বাধীনভাবে কর্মরতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা স্বজনহীনা, কখনও স্বেচ্ছায়, কখনও অনিচ্ছায়। তবে উপন্যাসগুলি মিলনান্তক। বড়োদের উপন্যাসেও লেখিকার ভাষার সরসতা এবং বিষয়ের সরলতা লক্ষণীয়।

লেখিকা লিখেছেন আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আর কোনোখানে’, ‘পাকদন্ডী’ এবং ‘খেরোর খাতা’। এইসব গ্রন্থগুলি থেকে শিলং, শান্তিনিকেতন এবং কলকাতায় লেখিকার জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। আকাশবাণীতে ‘মহিলামহল’-এ ‘ঠাকুমার চিঠি’ নামক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের সুবাদে রচনা করেছিলেন ‘মণিমালা’, যাকে ‘মেয়েদের হ্যান্ডবুক’ বলে পরিচয় দিয়েছেন লেখিকা স্বয়ং।

এ ছাড়াও লিখেছেন রান্নার বই। তাঁর অনূদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল-‘ভারতে বিদেশী যাত্রী’, ‘চার বিচারকের দরবার’, ‘হ্যানস অ্যান্ডারসন রচনাবলী’, ‘বাঘদাঁত’ ইত্যাদি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্প বিষয়ক লেখাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন তিনি। অন্যান্য লেখকদের সাথে যুগ্মভাবে লিখেছেন ‘হীরে মোতি পান্না’, ‘টাকা গাছ’, ‘হট্টমালার দেশে’ ইত্যাদি গ্রন্থ। এসবের বাইরেও সম্পাদিকা হিসেবে একাধিক গ্রন্থে তাঁর সুন্দর লেখনীর স্পর্শ রয়েছে।

সারাজীবনব্যাপী তাঁর সাহিত্যচর্চা এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার এবং সম্মান। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ওপর বই লিখে পান ভারত সরকারের শিশুসাহিত্য পুরস্কার। ‘হলদে পাখির পালক’ পুরস্কৃত হয় দু-বার। ‘বকবধ পালা’র জন্য পান সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, ‘আর কোনোখানে’র জন্য পান রবীন্দ্র পুরস্কার। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য শিশুসাহিত্য পরিষদ তাঁকে ভুবনেশ্বরী পদক প্রদান করে। পেয়েছেন ভুবনমোহিনী দাসী সুবর্ণপদকও। এ ছাড়াও পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, সুরেশ স্মৃতি পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার এবং মৌচাক পুরস্কার। বিশ্বভারতী প্রদত্ত ‘দেশিকোত্তম’ উপাধির পাশাপাশি পেয়েছেন কলকাতা, বর্ধমান ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিলিট উপাধিও।

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লিখলেও সেই কাজের মধ্যে তিনি তৃপ্তি পেতেন না। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি- “সত্যি কথাই বলব আমার হৃদয় মথিত করে, দম বন্ধ করে দিয়ে ‘আর কোনোখানে’ আর আরো দু’তিনটে গল্প বাদে বড়দের জন্য লেখা আমার কোনো গল্পের জন্ম আমার হৃদয়ের মর্মমূলে নয়, বরং আমার মস্তিষ্কের উন্ন অসহিষু কোষে কোষে। সত্যিকার সাহিত্যের জন্ম সেখানে নয়। ” তাঁর সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে ছিল ছোটোরা। তাদের জন্য লিখেই তিনি সবথেকে ঐ বেশি আনন্দ পেতেন। বাংলা শিশুসাহিত্যের সুবর্ণযুগের তিনি ছিলেন • এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কস্বরূপ। তিনি তাঁর সহজসরল প্রকাশভঙ্গি এবং • বিষয়বৈচিত্র্য দিয়ে বাংলা শিশু ও কিশোর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। শিশুসাহিত্যের মতো জটিল পরিধিতে তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী লেখিকার বড়োদের জন্য লেখা নানান রচনাও বাংলা সাহিত্যকে পরিপুষ্ট করেছে। তবে লীলা মজুমদারের সবথেকে বড়ো কৃতিত্ব সম্ভবত ছোটোদের মনোজগতের বিভিন্ন অনুভূতি, উপলব্ধি, – কল্পনা, চিন্তার হদিস করা এবং সেগুলিকে সার্থকভাবে সাহিত্যে পরিণত করতে পারা। আসলে তিনি নিজের মনের মধ্যে নিজের ছেলেবেলাকে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। সেইসব স্মৃতির নির্যাসেই গড়ে তুলেছেন এমন সব অনবদ্য রচনা, যেগুলি পড়লে আজও আমরা ছোটোবেলার অনাবিল আনন্দের স্বাদ পাই: আর তাই লীলা মজুমদার আজও আমাদের • কাছে খুব প্রিয়, একেবারে আমাদের ছেলেবেলার স্মৃতিগুলির মতো।

Leave a Comment