বিশাল হল ঘর-প্রচুর মানুষের সমাগম, হঠাৎ করে এমন এক একটা ব্যাপার ঘটে গেল যেন ভৌতিক কাণ্ড-কারখানা সব-ষ্টেজে তরুণ বিজ্ঞানী। মুখে তাঁর দৃপ্ততার ছাপ, চোখ দুটিতে দীপ্তি-একের পর এক বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন। বক্তৃতার মাঝেই হঠাৎ একটা পিস্তলের আওয়াজ-আর সঙ্গে সঙ্গেই পঁচাত্তর ফিট দূরের বন্ধ দরজার ভিতরের ঘর থেকে স্তূপাকার বারুদ উড়ে গেল। ঐ দরজার পাশে আরো কয়েকটা বন্ধ ঘর রয়েছে। কিন্তু কোন্ অদৃশ্য শক্তি যতদূর অবস্থিত ঘরগুলির দেয়াল ভেদ করে ঐ বিস্ফোরণ ঘটাল। কিছুক্ষণ পর দর্শক বুঝতে পারল, তরুণ বিজ্ঞানীর সামনে যে যন্ত্র রয়েছে তা থেকে বিদ্যুৎত্তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
এই কান্ডটির মধ্যে লুকিয়ে আছে একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূলীভূত রহস্য, বিনাতারে বার্তাপ্রেরণের গূঢ় সঙ্কেত। এই যন্ত্রটির উদ্ভাবক ঐ তরুণ বিজ্ঞানী- জগদীশচন্দ্র বসু। এ হল ১৮৯৫ সালের কথা, বেতারবার্তার কথা তখনো পৃথিবীর মানুষ শোনেনি।
জগদীশচন্দ্রের নাম ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। ভারতীয়রা শুধুই কল্পনাজগৎ বিহারী, এই অপবাদ ঘুচিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞানসভায় ভারতবর্ষকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করলেন জগদীশচন্দ্র বসু। বাঙালি হিসাবে বিশ্বের অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিককে নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি।
জন্ম ও পড়াশুনা: ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর জগদীশচন্দ্রের জন্ম হয় পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে। যদিও তাঁর পৈতৃক বাসভূমি ছিল ঢাকা জেলার বাড়িখাল গ্রামে। পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা বামাসুন্দরী। পিতার দরিদ্র মানুষের প্রতি অপরিসীম মমত্ব, অকৃত্রিম দেশপ্রেম, হৃদয়বত্তা, নৈতিকতা, চারিত্রিক বলিষ্ঠতা পুত্র জগদীশের সামনে এক আদর্শের সৃষ্টি করেছিল।
জগদীশচন্দ্র ফরিদপুরে গ্রাম্যবিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে, প্রথম হেয়ার ও পরে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়াশুনা করেন। এখান থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। এরপর এখান থেকে বি. এ পাশ করে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তুর পিতার ইচ্ছায় লন্ডনে গিয়ে ডাক্তারি পড়া শুরু করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য ডাক্তারি পড়া ছেড়ে বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হন। এখানে তিন বছর পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও উদ্ভিদ বিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করে ট্রাইপস লাভ করেন। এরপর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এস. সি..ডিগ্রী পান। পাঠশেষে আবার স্বদেশে ফিরে আসেন তিনি।
অধ্যাপনা: স্বদেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজে অস্থায়ীভাবে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। তখন ঐ কলেজে সাহেব অধ্যাপকদের তুলনায় দেশীয় অধ্যাপকদের বেতন ছিল কম। এই অন্যায় ও অযৌক্তিক বৈষম্যের প্রতিবাদে জগদীশচন্দ্র তিন বছর বিনা বেতনেই কাজ করেন। অবশেষে তাঁরই জয় হয়, তিনি সাহেব-অধ্যাপকদের সম-বেতনই লাভ করেন।
গবেষণা: অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজে বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজও শুরু হল। তখন এই গবেষণাকাজের জন্য সরকার থেকে একটুও আর্থিক সাহায্য পাননি তিনি। তাছাড়া প্রেসিডেন্সি কলেজের গবেষণাগারে উন্নত ধরণের যন্ত্রপাতিও ছিলনা। অর্থের অভাব, উপযুক্ত গবেষণাগারের অভাবের মধ্যেও বিদ্যুৎ আর ইথারের উপর গবেষণায় সাফল্য পেয়ে ডি. এস. সি. উপাধি লাভ করেন। বিদ্যুৎ তরঙ্গ সম্পর্কে গবেষণাকালিন বিনাতারে সংবাদ প্রেরণের একটা পরিকল্পনা করেন। বেতার আবিষ্কারক ইতালী বৈজ্ঞানিক মার্কনি যে অমর গৌরবের আবিষ্কারক, জগদীশচন্দ্র এর অনেকটাই অংশীদার। Wire Telegraphy-র বিষয়ে মার্কনির আগেই তাঁর গবেষণা সাফল্য মন্ডিত হয়েছিল। কিন্তু অর্থাভাবে ও সহানুভূতি অভাবে সঠিক সময়ে ইওরোপ পৌঁছোতে না পারার জন্য মার্কনি এই অমর গৌরবের অধিকারী হলেন,-এ লজ্জা বাংলার, এ লজ্জা ভারতের।
১৮৯৬ সালে অদৃশ্য আলোক সম্পর্কে নতুন আবিষ্কার দেখাতে ইওরোপ যান জগদীশচন্দ্র। সেখানে বৃটিশ এসোসিয়েশানের পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত হন তিনি। সেখানকার বৈজ্ঞানিকরা তাঁর পরীক্ষা ও বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে যান।
গাছের প্রাণ আবিষ্কার: এরপর দেশে ফিরে জগদীশ চন্দ্র আত্মনিয়োগ করেন জড় আর অচেতনের সাড়া সম্পর্কিত গবেষণায়। জড় বৃক্ষেরও যে প্রাণ আছে। সুখ, দুখ অনুভূতি আছে, জন্ম-বৃদ্ধি-মৃত্যু আছে যন্ত্রের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে তিনি তা প্রমাণ করলেন। তাঁর এই আবিষ্কার বিজ্ঞান জগতে আনল এক যুগান্তাকারী দৃষ্টান্ত। ১৯০০ সালে প্যারিস থেকে নিমন্ত্রণ পত্র এল আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ্যা বিষয়ক সম্মেলনে যোগদান করার। সভায় তার বক্তৃতার বিষয় ছিল জীব ও জড় পদার্থের উপর বৈদ্যুতিক সাড়ার ঐক্য। সেই সভাতেই তিনি বাংলা তথা ভারতকে বিশ্ব বৈজ্ঞানিক সভাতেও সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯০২ সালে তিনি আবার ভারতে ফিরে আসেন।
এর পর আরো তিনবার ১৯০৭, ১৯১৪, ১৯২৮ সালে বিদেশে যান। উদ্দেশ্য-নিজের উদ্ভাবিত যন্ত্রাদির প্রচার। ১৯০৯ সালে তিনি স্বয়ংলেখ যন্ত্র (Resonat Recorder) তৈরি করেন। এর আগে তাঁর আবিষ্কার ‘ক্রেস্কোগ্রাম’ (১৯০৭)-যার সাহায্যে এক সেকেন্ডে উদ্ভিদের বৃদ্ধি মাপা যায়।
১৯১১ সালে তিনি সি. এস. আই উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯১৬ সালে ‘নাইট’ উপাধি ও ১৯২০ সালে F. R. S. হবার দুর্লভ সম্মান লাভ করেন। ১৯১৫ সালে সরকারী কাজ থেকে অবসর নেবার পরও সরকার তাঁকে পূর্ণ বেতনে আজীবন Emirates Professor নিযুক্ত করেন।
বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা: কাজ থেকে অবসর নেবার পর তাঁর প্রধান কীর্তি ১৯১৭ সালে কলকাতায় ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠা। বিজ্ঞান চর্চার পথ আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যই এ চর্চাকেন্দ্রের স্থাপনা।
সাহিত্য রচনা: জগদীশচন্দ্র শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিকই ছিলেন না, ছিলেন সুসাহিত্যিকও। তাঁরে সাহিত্যানুরাগ ধরা পড়ে ‘অব্যক্ত’ (১৯১১) গ্রন্থটিকে। এটি প্রধানত বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধের সঙ্কলন। তার লেখা চিঠিপত্রগুলিও সাহিত্যরস সমন্বিত।
মহাপ্রয়াণ: অত্যধিক পরিশ্রমে তাঁর শরীর ভেঙে যেতে লাগল। স্বাস্থোদ্ধারের জন্য মাঝে মাঝে তিনি গিরিডি যেতেন-সেখানেই ১৯৩৭ সালে ২৩শে নভেম্বর এই বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিকের দেহাবসান হয়। যতদিন এই মৃত্তিকার বুকে উদ্ভিদের প্রাণ স্পন্দিত হবে, জগদীশচন্দ্র ততদিন অমর থাকবেন আমাদের স্মৃতিকোঠায়।