এই পোস্টে দ্বাদশ শ্রেণীর প্রজেক্ট টপিক গ্রন্থ সমালোচনা থেকে সুকুমার রায়ের গল্পের ভূত প্রবন্ধটি দেওয়া হল, যেটি দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের প্রজেক্ট বা প্রকল্প নির্মাণে বিশেষ ভাবে সহায়তা করবে।
গল্পের ভূত
নিজের আত্মকথা দিনের পরে দিন যে গেল-র দুটি খণ্ডে ভাষাতত্ত্বের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক সুকুমার সেন বহুবার ভূতের প্রসঙ্গ এনেছেন। তাঁর পিতা হরেন্দ্রনাথ সেনের বহু বিষয়ে কৌতূহলের মধ্যে স্পিরিচুয়ালিজম ও ম্যানচেটও ছিল। সুকুমার সেনের বাল্যাবস্থায় কলকাতা শহরে বহু নির্জন অঞ্চল এবং পুরোনো ফাঁকা বাড়ি যেমন ছিল, তেমনই ছিল ভুতুড়ে বাড়ির ধারণা। অল্প বয়স থেকে মনের কোণে তৈরি হওয়া ভূতের ভয় পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে গবেষকসুলভ আগ্রহে পরিণত হয়। কখনও সহকর্মীদের কাছে, কখনও-বা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তিনি ভূতের গল্প অনেক শুনেছেন। ভূতের খবরকে অনেকবারই গুজব বলে জানলেও কখনও তিনি এ কথা বলেননি যে, অলৌকিকে তিনি বিশ্বাস করেন না। তবু বলা যায়, নিজের মনটিকে তিনি মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন।
শ্রীমান পাঁচুগোপাল রায়কে গল্পের ভূত বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে। বর্ধমানে থাকাকালীন শ্রী সেন একটি সাহিত্যসভার প্রাণকেন্দ্র ও প্রধান সদস্য ছিলেন। সেই সভায় নিয়মিতই চলত ভূতের গল্পের আসর। সেই আসরের বন্ধুই এই পাঁচুগোপাল রায়। ২৭.৮.৮২ তারিখে পদ্যছন্দে লিখিত উৎসর্গপত্রটি অসামান্যতার দাবি রাখে; যার শেষাংশে তিনি লেখেন-
‘সাহিত্যসভায় তুমি তো হাজির সাক্ষী অংশীদার,
তাই তো তোমায় এই বইখানি দিনু আমি উপহার।।’
গল্পের ভূত বইটি গল্পগ্রন্থ না, ভূত সম্পর্কিত ছ-টি প্রবন্ধের সংকলন। বহুদিন আগে বিশ্বভারতী পত্রিকায় ‘আমাদের সাহিত্যে ভূতের গল্প’ নামে একটি প্রবন্ধ তিনি রচনা করেন। এই বইটি তারই সম্প্রসারিত রূপ। অত্যন্ত অল্প পরিসরে, ভূমিকা থেকে আরম্ভ করে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বইটি বহু অভিনব তথ্য ও গভীর জ্ঞাতব্য বিষয়ের আলোচনায় পূর্ণ।
‘গল্পের ভূত, ‘একটি খুব প্রাচীন গল্প’, ‘ভূতের গল্প’, ‘দেশ-বিদেশের ভূত’, ‘সমাজে-ভূত’ এবং ‘ভূতের ছবি’-এই ছয়টি প্রবন্ধের সংকলন গ্রন্থটি ‘ভূত- তাত্ত্বিকের জন্যে লেখা হয়নি। মূলত নিজের কৌতূহল মেটানোর জন্যই লেখাগুলি তৈরি’, কেন-না লেখক মনে করেন ‘শুধু জানলে কৌতূহল মেটে না, সেটাকে হজম করে লিখে অন্যের বোধগম্য করে প্রকাশযোগ্য রূপ দিলে তবেই কৌতূহলের তৃপ্তি হয়।’ তাই গ্রন্থপাঠের অধিকারী নির্বাচন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন-‘এ লেখা আমার নিজের জন্যে এবং আমার সবভাবুক ভূতবাতিকের জন্যে।’…. যাঁরা যথার্থ জিজ্ঞাসু Cultural historian, তাঁরা পুস্তিকাটি পড়লে উপকৃত হবেন। বইতে থাকা সাদা-কালো আধুনিক ছবিগুলি শিশুদের জন্যে আঁকা, আর প্রাচীন চিত্রগুলি বড়োদের জন্যে।
‘ভূমিকা’ অংশে তত্ত্বকথা শোনানোর আগ্রহে তিনি উল্লেখ করেছেন- ভারতবর্ষের সর্বত্র লৌকিক ভাবনায় দুটি শ্রেণির অপ্রাকৃত জীব আছে, রাক্ষস ও ভূত (বা পিশাচ)। অর্থাৎ, তাঁর মতে ভূত ও পিশাচ একই। কিন্তু এ বিষয়ে আলাদা মত গবেষণায় চোখে পড়ে-‘ভূত’ শব্দটি সাধারণভাবে যে কোনো অপসত্তা সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়। ‘পিশাচ’ সে জাতীয় ভূত নয়। বেদে রয়েছে, পিশাচ রাক্ষসের মতোই ভয়ংকর অপসত্তা। দুর্গাচরণ লাহিড়ী সম্পাদিত বেদের অনুবাদের ব্যাখ্যায় লেখা হয়েছে-পিশাচ ‘পিশিত’ বা কাঁচা মাংস খায়-এমন ক্ষতিকারক অপসত্তা। সুকুমার সেন কেন রাক্ষস ও ভূতের পাশে বন্ধনীতে ‘পিশাচ’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন, তার যথাযথ ব্যাখ্যা বইটিতে নেই। ভৌতিক অপসত্তার মধ্যে তিনি দৈত্যদানব, রাক্ষস-রাক্ষসী, গর্ব- অপ্সরা, ভূত, পেত্নি, বুরুস, ব্রহ্মদৈত্য, যক্ষ, জিন, মামদো, ডাইন, খোক্কসের কথাও শুনিয়েছেন। ভূত সম্পর্কে সাধারণ ধারণাগুলির সঙ্গে নারীপ্রেতাত্মা সম্পর্কে বিচিত্র সব খবরাখবর দিয়েছেন। বেদ, উপনিষদ, আরব্যরজনীর গল্প, কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত, মুকুন্দ ও ভারতচন্দ্রের মঙ্গলকাব্য, গুণাঢ্যের বৃহৎকথা, কথাসরিৎসাগর, বেতাল পঞ্চবিংশতি থেকে অজস্র উদাহরণ তিনি উল্লেখ করেছেন। বেদ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ হয়ে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত ভূতের গল্প শুনিয়েছেন লেখক। বিদেশি ভূতের প্রসঙ্গে ‘ভ্যাম্পায়ার’ ও ‘লাইক্যানথ্রপি’ দিয়ে লেখা গল্পের কথা এসেছে। লোকবিশ্বাস থেকে আতৃহৃত গোভূত, ঘোড়াভূত, পেঁচো-গেছো-মেছো ভূত, গলাশি, একানড়েও তাঁর লেখায় বাদ যায়নি। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে, বিশ্লেষণী ও গবেষকসুলভ মন নিয়ে তিনি তাঁর প্রতিটি রচনাকে এক অপরূপ প্রসন্নতার সঙ্গে গড়ে তুলেছেন।
Zombie-র কথা একটি গল্পে এসেছে। যারা মৃত হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে একধরনের প্রাণের অস্তিত্ব। প্রসঙ্গত কোলরিজের ‘রাইম অফ দি এনশিয়েন্ট মেরিনার’-এর কঙ্কাল জাহাজের বর্ণনার কথা স্বভাবতই মনে আসে, যেখানে যন্ত্রের মতো দাঁড় বেয়ে চলে প্রাণহীন নাবিকেরা। সুকুমার সেন এক্ষেত্রে কোলরিজের কথা উল্লেখ করেননি। গ্রন্থের ক্ষুদ্র আয়তনের কারণেই সম্ভবত রামায়ণ মহাভারতের রাক্ষসেরা আলোচনায় স্থান পায়নি।
গ্রন্থে লেখক ভূতের সংজ্ঞার্থ নিরূপণ করতে গিয়ে লিখেছেন-ভূত হল ‘মরা ইত মানুষের না-মরা ছাঁচ।’ এমনই ভাবে সংক্ষিপ্ততা ও অর্থবহতা হয়ে উঠেছে এই গ্রন্থের প্রাণ। প্রসঙ্গত বলা দরকার, সুকুমার সেন ও সুভদ্রকুমার সেন ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত উপছায়া নামক একটি ভূতের গল্পসংকলন সম্পাদনা সে করেছেন। তাঁর ভূমিকাটি সুকুমার সেনের লেখা। সেখানে তিনি বলেছেন- ‘হতেও পারে, আবার না হতেও পারে’-এই সংশয়টাই ভূতের গল্পের মূলরস। দ্বিতীয়ত তাঁর মনে হয়েছে, হাস্যরস ও কৌতুকভঙ্গিতে ভূতের গল্প ঠিকমতো বলা যায় না। একটু শঙ্কামিশ্রিত, গা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে ভূতের গল্পের রচনাশৈলী অসার্থক থেকে যায়।
৭০ পৃষ্ঠার বইটি সত্যপ্রিয় সরকারের প্রচ্ছদে অনবদ্য। বইটির ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন বিশ্বভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আমাদের সাহিত্যে ভূতের গল্প’ প্রবন্ধের শেষে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন-‘বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।’ কিন্তু তা হয়নি। গল্পের ভূত গ্রন্থপ্রকাশের মধ্য দিয়ে সেই অকর্ষিত ক্ষেত্রটিতেই তিনি স্বমহিমায় বিরাজ করেছেন।