আজকের পোস্টে পরিবেশদূষণ ও তার প্রতিকার নিয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা শেয়ার করা হল, যেটি উচ্চমাধ্যমিক এবং মধ্যমিয়ক শিক্ষার্থীদের ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতিতে বিশেষ ভাবে সহায়তা করবে। অতএব রচনাটির মধ্যে এক বার চোখ বুলিয়ে নাও, ভালো লাগলে সংগ্রহ করে রেখে দাও।
পরিবেশদূষণ ও তার প্রতিকার
ভূমিকা: প্রায় ৪০০-৬০০ কোটি বছর পূর্বে সূর্যের গ্যাসীয় ভগ্নাংশ থেকে সৃষ্ট হওয়া আশ্চর্য সুন্দরী এই পৃথিবীর বুকে নৈসর্গিক বা প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশের জন্য একদিন সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার অন্তর্বর্তী স্থানে প্রাণের প্রথম সপ্তার হয় বলে অনুমান করা হয়। এবং এককোশী জীব থেকে ক্রমবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর বুকে উদ্ভিদ ও প্রাণীর সৃষ্টি হয়। আর এই ক্রমবিবর্তন প্রক্রিয়াই পৃথিবীতে একদিন উন্নত মস্তিষ্কবান মানুষকে নিয়ে এল। শুধু হয়ে গেল অস্তিত্বরক্ষার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে আপসহীন লড়াই। আর সেই লড়াইয়ের অলা হিসেবে মানুষ প্রকৃতি সংহারকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিল।
দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর বিজ্ঞানের ক্রম অগ্রগতি, পৃথিবীতে নিয়ে এল অতিযান্ত্রিকতা ও নাগরিকতার বিস্তার। ফলে মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ এবং নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থ পরিবেশকে দিনের পর দিন দূষিত করে চলেছে। তাই পৃথিবীতে প্রাণসঞ্চার কালের সেই নির্মল পরিবেশ আজ আর নেই। মানুষের নির্বিচার প্রকৃতিসংহার পরিবেশকে রুক্ষতায় আর শুদ্ধতায় ভরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ আমাদের সবাইকে সচেতন হয়ে পরিবেশের এই ভয়ংকর দূষণ প্রতিরোধ করতে হবে, প্রতিহত করতে হবে, প্রতিকার করতে হবে।
মানব সভ্যতার অগ্রগতি ও পরিবেশদূষিতকরণের সূত্রপাত:
মানুষ যেদিন থেকে প্রকৃতিকে নিজের করায়ত্ত করতে চাইল, সেদিন থেকে প্রকৃতির ফধ্বংসলীলা শুরু হয়ে গেল। আগুন আবিষ্কৃত হওয়ার সল্যে সলো মানবসভ্যতা কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলেও সূচিত হল প্রাণের ধাত্রী অক্সিজেনের ধ্বংসলীলা। আগুন কেবল অক্সিজেনের পরিমাণকে হ্রাস করল না, পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে তাকে কলঙ্কিত করে তুলল। নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন এবং নগরায়ণ ধরণিকে করে তুলল মরুর মতো বুক্ষ, পবিত্র নদীবক্ষে নিক্ষেপিত হল কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ, তীর্থবারি হয়ে উঠল পঙ্কিল জলাশয়। তাই বড়ো দুঃখে, বড়ো ব্যথায় ইতিহাসের হারানো পথের অনুসন্ধানে বড়োই ব্যাকুলতা, বড়োই মর্মস্পর্শী আবেদন ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’।
পরিবেশদূষণের প্রকারভেদ
এই পরিবেশ দু-ভাবে দূষিত হয়ে থাকে-প্রথমত, সাধারণ দূষণ। দ্বিতীয়ত, তেজস্ক্রিয়দুষণ। সাধারণ দূষণে পরিবেশের স্বাভাবিক গুণমানের অবাঞ্ছিত পরিবর্তন সাধিত হয় এবং জীবদেহের অভূতপূর্ব ক্ষতি হয়। এই সাধারণ দূষণ মোটামুটি চারভাগে বিভক্ত যথা-মাটিরদূষণ। জলদূষণ। বায়ুদূষণ। শব্দদূষণ।
মাটিদূষণ: সমস্ত জীবকূলের অবস্থান যে মৃত্তিকার ওপর, সেই মৃত্তিকাও আজ দুধিত হয়ে চলেছে। ভূমণ্ডলের এই মৃত্তিকা পাঁচটি হরাইজন বা স্তরে বিভক্ত, যথা-O, A, B, C এবং এবং এর প্রধান উপাদান হল খনিজ পদার্থ, জৈব পদার্থ, জল, বায়ু এবং ক্ষুদ্র জীবকুল। শহরাঞ্চলে কলকারখানার পরিত্যাজ্য বর্জ্য পদার্থ এবং গ্রামে গৃহস্থালির বর্জ্য পদার্থ ও ফসল উৎপাদনের জন্য মাটিতে প্রয়োগ করা নানাধরনের কীটনাশক (ক্লোরিনেটেড, হাইড্রোকার্বন যথা-DDT, BHC, আলড্রিন প্রভৃতি) মাটির এই সমস্ত উপাদানকে বিনা করে তাকে দুষিত করে চলেছে।
জলদূষণ: জল ছাড়া জীবনের কল্পনা করা বৃথা। কিন্তু বিশুল জলের হদিশ পাওয়া তার। সমগ্র পৃথিবীর ৭৩ শতাংশ জল দ্বারা গঠিত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল পৃথিবীর সমগ্র জলের মাত্র ১ শতাংশ আদুজলের উৎস হিসেবে নদী পুকুর, হ্রদ, ভূগর্ভে বর্তমান। তাও আবার জল ভাসমান বস্তুকণা, দ্রাব্য রাসায়নিক, অদ্রাব্য রাসায়নিক ও জীবাণু আরা সুষিত হয়ে চলেছে। অসংখ্য কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ পবিত্র নদীবক্ষে নিক্ষিপ্ত হয়ে তাকে পূতিগন্ধময় নরকের দ্বারে পরিণত করেছে।
বায়ুদূষণ: মানুষসহ সমস্ত জীবকুলের বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান ০, যে বায়ুমন্ডলের অন্তর্গত তার সর্বশরীরে আজ দুরারোগ্য ব্যাধির ক্ষতচিহ্ন পরিদৃশ্যমান। নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, আর্গন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, জলীয় বাষ্প, ধূলিকণা ইত্যাদির সংমিশ্রণে গঠিত বায়ুমণ্ডল আজ সারাবিশ্বে বিষাক্ত দূষণের শিকার। আকাশযান ও মহাকাশযানের ঘনঘন বায়ুমণ্ডল পরিক্রমা, উন্নত দেশগুলির বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ ও মূলত গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করে।
শব্দদূষণ: দূষণ শুধু বায়ুতে নয়, জলে নয়, শব্দেও। যন্ত্রদানব কত-না শব্দদানবও সৃষ্টি করেছে এ বিশ্বে, তারই উপযুক্ত সন্তানরূপে। নগরে হর্নের বিকট চিৎকার, মাইকের কড়া সুর, বাজি-পটকার কানফাটা আওয়াজ, এমনকি শববাহীদের হঠাৎ হঠাৎ প্রচণ্ড উল্লাসে ফেটে পড়া তীব্র চিৎকার, সব মিলেমিশে এখানে প্রতিনিয়তই এক অপম্বর সৃষ্টির মহাযজ্ঞ চলছে। শব্দদূষণের ফলে শ্রবণক্ষমতার বিলোপ ঘটে। মানসিক বিপর্যয় দেখা যায়। শব্দের ২০-৫০ ডেসিবেল পর্যন্ত মাত্রা হল স্বাভাবিক। কলকাতায় এখন শব্দের পরিমাণ ৬০-৬৫ ডেসিবেল, কোথাও ৮০ ডেসিবেল।
তেজস্ক্রিয়দূষণ: পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অথবা পারমাণবিক বোমাবিস্ফোরণ থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় পদার্থ মাটিতে মিশে যে দূষণের সৃষ্টি করে তাকে বলা হয় তেজস্ক্রিয়দূষণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্তিমবর্ষে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের ভয়াবহতার কথা মাথায় রেখেও এখনও তার উৎপাদন প্রক্রিয়া চলছে সারাপৃথিবী জুড়ে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, এই তেজস্ক্রিয়তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এদিকে পৃথিবীর ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে রাসায়নিক জীবাণুযুদ্ধের প্রস্তুতির প্রতিযোগিতা। ফলে পরিবেশদূষণ ধারণ করেছে এক মারাত্মক আকার।
প্রতিক্রিয়া:
পরিবেশদূষণের ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের নিদারুণ ক্ষতি হয়। মাটির দূষণের ফলে বিভিন্ন রোগ ও মহামারির রোগজীবাণুবাহী কীটপতলের জন্ম হয়। মাটির দূষণের সবচেয়ে ক্ষতিকর উদাহরণ হল তেজস্ক্রিয়দূষণ। এর ফলে গামা বিকিরণে প্রাণীর দেহকোশ অচিরেই নষ্ট হয়ে যায়। ক্যানসার, বিকলালা শিশুর জন্ম, বংশানুক্রমের পরিবর্তন ঘটায়। এমনকি তৃণস্থ শিশুরও ক্ষতি করে। বায়ুদূষণের প্রভাবে হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া, ফুসফুসে ঘা, হৃৎপিন্ডের অসুখের দুরারোগ্য ও দীর্ঘস্থায়ী রোগ দেখা যায়। জলদূষণের প্রভাবে যাবতীয় পেটের রোগ, আর্সেনিক এবং নানা রকমের দুরারোগ্য ব্যাধির উপদ্রব ঘটে। শব্দদূষণের ফলে স্থায়ী বা সম্পূর্ণ বধিরতা, হৃৎস্পন্দনের হারের তারতম্য, রক্তচাপ বৃদ্ধি ও হ্রাস, স্নায়ুতন্ত্রের বিকলতা এমনকি মানসিক রোগেরও সঞ্চার হতে পারে।
পরিবেশদূষণ ভারতে ও পৃথিবীতে
আজ ভারতসহ পৃথিবীর দিকে দিকে আবহাওয়ার চিত্র অত্যন্ত মসিলিপ্ত। কেবল ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দেই আমেরিকা ও রাশিয়া দ্বিশতাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে নিক্ষেপ করেছে এবং ভূগর্ভে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে শতাধিক। বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বলোকে ক্রমাগত রকেট নিক্ষেপের ফলে স্ট্যাটোস্ফিয়ারের পাবনায়বিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে শতাধিকতাসমতী। তার ফলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে উদ্ভিদ তোমাদায়ী গ্যাস হারিয়ে ফেলতেছে প্রাণঘাতী। এদিকে ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন মোটরযান থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসে বায়ুদূষণ অত্যান্ত বেশি। ভারতের বৈষয়িক অগ্রগতির স্বার্থে দিকে দিকে আজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বর্ণভূমিতে গড়ে উঠছেনখানা তনয় নগরী। তার পরিণামে পরিবেশষেণ যোলোকলায় পূর্ণ। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে গভীর রাত্রে মধ্যপ্রদেশের ভোপালের ভয়ংকর গ্যাস দুর্ঘটনায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষসহ অসংখ্য গবাদিপশুর অকালমৃত্যুর কথা আজও আমরা ভুলিনি।
প্রতিকার:
এইভাবে দূষিত এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় একদিন জীবন হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে আমাদের এই প্রিয় গ্রহ থেকে। সেজন্য আবহাওয়া দূষণ সম্পর্কে মানবজাতিকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ৫ জুন ‘বিশ্বপরিবেশ দিবস’ রূপে পালিত হয়। আজ আর আবহাওয়া দূষণ নয়, চাই তাই বিশুদ্ধিকরণ।
উপসংহার: তাই আজ অরণ্যসংহার নয় প্রতিটি মানুষের জন্য চাই আনুপাতিক হারে অরণ্য সৃষ্টি। অতিরিক্ত কয়লা ব্যবহার হ্রাস করা দরকার। কার্বন মনোক্সাইডের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাবার জন্য পুরোনো গাড়িগুলির পরীক্ষা করা দরকার। সেইসঙ্গে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে রকেট নিক্ষেপণ ও পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ হওয়া চাই। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আমরা চলতে পারি না। কবির আবেগকে প্রশ্রয় দিয়েও আমরা আর ফিরে যেতে পারি না সে অরণ্যভূমিতে। এ শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জেই আমাদের থাকতে হবে, বিজ্ঞানের অগ্রগতিও চালাতে হবে। তবে যে বিজ্ঞান বুদ্ধি প্রধানত এ পরিবেশদূষণের জন্য দায়ী, তাকেই আজ দায়িত্ব নিতে হবে রূপসি পরিবেশের পুনর্নির্মাণের। জল, বায়ু ও শব্দকে প্রশাসনের সাহায্যে বিজ্ঞানকেই করতে হবে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত। পৃথিবীকে করতে হবে মানুষের বাসযোগ্য।