প্রতি এক মিনিট-দেড় মিনিট অন্তর বেজে উঠছে সাইরেন, অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষিপ্রগতি, সেনাবাহিনীর প্রশান্তকর প্রয়াস, ভূত্বকের হঠাৎ মোচড়ে মুহূর্তেই বদলে যাওয়া ছবি-ভূ-কম্পনের ফলে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বারে বারে ঘটেছে এমন কত-না বিপর্যয়। বড়ো বড়ো শহর পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে, সাদা কাপড়ে ঢাকা সারি সারি মৃতদেহ, আহত পরিজনদের আর্তক্রন্দনে ভারী হয়েছে আকাশবাতাস। প্রকৃতির তাণ্ডবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে বহুতল অট্টালিকা, কাংস হয়ে যায় কত সৌধ মিনার, কত ঐতিহ্যবাহী মন্দির, মসজিদ, গির্জা। প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায় তা অনুভব করা যায় প্রকৃতিরই নানা খামখেয়ালিপনায়। ভূমিকম্প প্রকৃতিরই এক ভয়ঙ্কর খামখেয়ালি রূপ।
ভূমিকম্প কী:
সাধারণভাবে পৃথিবীপৃষ্ঠের আকস্মিক কেঁপে ওঠাকে ভূমিকম্প বলা হয়। আকস্মিক এবং ক্ষণস্থায়ী ভূত্বকীয় কম্পনকে ভূবিজ্ঞানীরা ভূমিকম্প বলে অভিহিত করেছেন। ভূবিজ্ঞানী স্টুলার বলেছেন-“An earthquake is a trembling or shaking of the ground produced by the passage of seismic waves!”
ভূমিকম্পের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য:
ভূমিকম্পের নানা বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন –
- ভূ-অভ্যন্তর থেকে এর উৎপত্তি হয়।
- কোনো নিদিও সময়সীমা নেই। তবে এটি ক্ষণস্থায়ী হয়।
- কোনো জায়গায় বড়ো ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আগে খুব সামান্য সময় হালকা ভূমিকম্প হয়ে থাকে।
- বড়ো কোনো ভূমিকম্প ঘটার পর বেশ কয়েকবার ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। এই ঘটনাকে পরবর্তী কম্পন বা After Shock বলে অভিহিত করা হয়।
কেন হয়?
ভূমিকম্প কেন হয় যে বিষয়ে সারা পৃথিবীর ভূবিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে, ভূত্বকে অনেকগুলি। হেটে বড়ো পাথরের চাদর থাকে। শিলায় নির্মিত এই চাদরগুলোকে প্লেট বলে। এই পাতগুলো সচল, এই পাতগুলো যখন চলতে চলতে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায় বা হালকা পাতের নীচে যখন ভারী পাতটি প্রবেশ করে তখনই ভূকম্পন অনুভূত হয়। মুতকের শিলাস্তরে যখন কোনো কারণে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয় তখন শক্তির সঞ্চয় ঘটে। এই শক্তি সঞ্চয়ের ফলে শিলাস্তরের স্থিতিস্থাপকতা বিনন্ট হয়ে শিলা বিকৃত হয়, ফাটলের সৃষ্টি হয় এবং সেই ফাটল বরাবরই শিলাস্তূপে চাতি সৃষ্টি হয়। শিলাস্তরে সঞ্চিত বিপুল শস্ত্রি হঠাৎ মুস্ত হয়েই ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়।
কিছু কিছু ভূমিকম্প মানুষের দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে। যেমন-মাটির নীচে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে তৃত্বকে কম্পন অনুভূত হয়। পাহাড়ের হস নামলেও ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভূমিকম্পের পূর্বাভাষ দেওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয় বাসেই ভূবিজ্ঞানীরা মনে করেন। তবে প্রাণীজণাৎ ভূত্বকের কম্পনের পূর্বাভাষ কিছু সময় আগেই বুঝতে পারে যা তাদের। নানাবিধ আচরণে ধরা পড়ে।।
সাম্প্রতিক ভূমিকম্প: বিপর্যস্ত নেপাল
বিগত ২০০ বছরে হিমালয় পর্বতমালার অর্ধেক বিস্তৃতি জুড়ে অন্তত সাতটি উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ঘটেছে। এগুলির মথে তিনটিরই অবস্থান নেপালে (১৮০৩, ১৮৫৩, ও ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে)।
২৫ এপ্রিল, ২০১৫ নেপাল কেঁপে উঠেছিল এক বিলাসী ভূমিকম্পে। ভারতীয় সময় বেলা ১১টা ৪১ মিনিটে পোখরার লোপজাতে জন্ম নেওয়া ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭.৯। ঠিক পরপরই অন্তত ১৬ বার আফটার-শকে কেঁপে উঠেছিল মাটি। Indian National Geographical Research Institute-এর তথ্য অনুযায়ী ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের পর নেপালের। ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বিলাসী ভূমিকম্পের ঘটনা।
কাঠমান্ডু শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নির্জন পাহাড়ি এলাকার মাটির ১১ কিলোমিটার গভীরেই ছিল এই কালান্তক ভূমিকম্পের উৎসস্থল। ভূগর্ভস্থ যে প্লেটগুলোর উপরিতলে। অবশ্যিত আছে মহাদেশ ও মহাসাগরগুলি তার মধ্যে দুটি প্লেটের রেষারেষির ফল এই মারাত্মক ভূমিকম্প। এদিন দুপুরে ভারতীয় প্লেটটি পিষলে ঢুকে পড়ে ইউরেশীয় প্লেটের নীচে-এর ফলে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়েছিল তারই জেরে কেঁপে উঠেছিল কাঠমান্ডু থেকে দিল্লির বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড। কম্পন কোথাও স্থায়ী হয়েছিল এক মিনিট, কোথাও দেড় মিনিট কোথাও বা দু-মিনিট।
দাংসলীলার জন্য এই সময়টুকুই ছিল যথেষ্ট, কারণ দুটি প্লেটের সন্ধান পরিবর্তনে যে পরিমাণ শস্থির নির্গমন ঘটেছিল তার কাছে পরমাণু বোমা অতি-অতি সামান্য। সেদিনের ভূকম্পের কারণ বিশ্লেষণে খড়গপুর আই, আই, টির বিশেষজ্ঞ শঙ্কর কুমার নাথ জানিয়েছেন-“হিমালয় তৈরি হওয়ার সময় থেকেই ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে-কে কার নীচে পিছলে যাবে। এর ফলেই দুটি প্লেটবরাবর তৈরি হয়েছে কয়েকটি চ্যুতি বা ফাটল। কয়েকটি চ্যুতি বেশ বড়ো মাপের। সেগুলি ‘গ্রাস্ট’ বা খোঁচা। ভূমিকম্পগুলি তৈরি হয় এই চ্যুতি ও খোঁচায় অতিরিন্ত শন্তি সঞ্চয়ের জন্য।” (তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা)
এই ভূমিকম্পের ফলে নেপাল পরিণত হয়েছে মৃতার দেশে। প্রায় ৯ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, হতাহতের সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। বহু অট্টালিকা ধূলিসাৎ হয়েছে, গুলোয় মিশে গিয়েছে ঐতিহ্যের ন’তলা ধরহরা মিনারটি। গত ৮০ বছরের মধ্যে ভূমিকম্পের এমন আগ্রাসন দেখেনি এখানকার মানুষ। চারিদিকে ফাংসস্তূপ, মৃত্যু, হাহাকার।
তবে আশা ও ভরসার বিষয় এই যে, ভূমিকম্প বিধ্বস্ত নেপালের প্রতি সারা বিশ্বের বহু দেশ চূড়ান্ত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত সরকার সমস্ত রকম সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়েছে, রাষ্ট্রসংঘ সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে, হোয়াইট হাউসের তরফে প্রয়োজনীয় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এই মানবিক আচরণই আমাদের জীবনপথের পাথেয়।
ভূমিকম্পের সময় যা করণীয়:
ক্ষণস্থায়ী ‘বিপর্যয় ভূমিকম্প। প্রস্তুতি পর্ব থাকে না, তাই মুহূর্তের সিদ্ধান্তে নিম্নোক্ত বিষয়গুলির দিকে নজর দেওয়া দরকার।
- বাড়ির ভিতরে থাকলে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ানো।
- তীত হয়ে দিশেহারা না হয়ে পড়া।
- গ্যাস/মোমবাতি/স্টোভ জ্বলন্ত অবস্থায় থাকলে তা নিভিয়ে ফেলা।
- লিফ্ট বা এসকেলেটর না চড়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা।
- কোনো ঝুলন্ত দেওয়ালের পাশে বা বড়ো পুরোনো বাড়ির পাশে দাঁড়ানো উচিত নয়।
উপসংহার: প্রকৃতির দিকে নজর না দিয়ে যথেচ্ছ অরণ্যধ্বংস এবং অপরিমিত বহুতল বানানোর লোভ আমাদের ঠেলে দিয়েছে আজকের এই ভয়াবহ পরিণতির দিকে। ভূমিকম্পে বহু মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু মানুষ নিজেই তার বহুগুণ বেশি সর্বনাশ করে চলেছে। গত ২২ এপ্রিল নিঃশব্দে পার হয়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিক ভূ-দিবস (Earth Day)। ভ্যালেন্টাইন থেকে বন্যপ্রাণীদিবস সবই। আমরা সাগ্রহে সুমধাম করে পালন করি, কেবলমাত্র পৃথিবীর কথা মনে হয় ভয়ঙ্কর সুনামি বা প্রবল খরা বা ভূমিকম্পের বিপর্যয়ের পর।
মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে, এখানে সহযোগিতা ও সহমর্মিতাই সবচেয়ে বড়ো কথা। দুর্গত মানুষের অসহায় কান্নায় ভারী হওয়া বাতাস যেন আরো কান্নার কলরবে ভরে না ওঠে সেদিকেই আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত ত্রাণ ও পরিষেবা তাদের কাছে দ্রুত পৌঁছে যাওয়াই সবচেয়ে বড়ো কর্তব্য হওয়া উচিত।