এই পোস্টে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বাংলা বিষয় এর একটি প্রজেক্ট বা প্রকল্প শেয়ার করা হল, যেটি তাদের প্রজেক্ট বা প্রকল্প নির্মাণে বিশেষ ভাবে সহায়তা করবে।
ফেলুদা চরিত্রের জীবনী নির্মাণ
সত্যজিৎ রায় রচিত বাংলা সাহিত্যের এক খ্যাতনামা গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা। প্রকৃত নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। বিলাতি কায়দায় বলেন প্রদোষ সি মিটার (Pradosh C Mitter)। অজস্র বাংলা গোয়েন্দা উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক তিনি। কলকাতায় বালিগঞ্জের ২১নং রজনী সেন রোডের বাড়িটি তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে সন্দেশ পত্রিকায় (সত্যজিৎ রায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত) ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ রচনায় এই চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। অধিকাংশ সময়েই ফেলুদার সঙ্গী তপেশ (যাকে তিনি আদর করে তোপসে বলে ডাকেন), সম্পর্কে এই চরিত্রের খুড়তুতো ভাই। গল্পের কথক এই তোপসে। ফেলুদার ষষ্ঠ গল্প ‘সোনার কেল্লা’ থেকে তাঁদের রহস্য রোমাঞ্চ অভিযানের সঙ্গী হন জটায়ু (লালমোহন গাঙ্গুলি)। বিভিন্ন সময়ে ফেলুদার নানান কাহিনি নিয়ে অজস্র চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪) এবং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৮) স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশনাতেই তৈরি। তাঁর সুযোগ্য পুত্রের পরিচালনায় ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চারভিত্তিক অনেক টেলিফিল্ম ও চলচ্চিত্র তৈরি হয়ে চলেছে।
স্কুলজীবনেই সত্যজিৎ রায় গভীর মনোযোগ সহকারে শার্লক হোমসের সব ‘ক্রাইম কাহিনি’ পড়ে ফেলেন। ‘ফেলুদা’ চরিত্রে শার্লক হোম্স এবং ‘তোপসে’ চরিত্রে হোমসের সহযোগী ড. ওয়াটসনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এমনকি, ফেলুদাকেও অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে শার্লক হোমসের নাম একাধিকবার উচ্চারণ করতে শোনা যায়। এই প্রসঙ্গে ‘কৈলাস চৌধুরির পাথর’ ও ‘লন্ডনে ফেলুদা’-রচনা দুটি স্মরণীয়।
প্রথম সাক্ষাতের সময় ফেলুদার বয়স ছিল ২৭, উচ্চতা ৬ ফুট ২ ইঞ্চি। খেলাধুলোয় সুগঠিত তাঁর শরীর। শারীরিক ক্ষমতার চেয়েও তিনি বেশি গুরুত্ব দিতেন মগজাস্ত্রের উপর। ক্ষুরধার বুদ্ধি, তীক্ষ্ণ বিচক্ষণতাতেই তাঁর সাফল্যের মূলসূত্রটি নিহিত। তাঁর সঙ্গে থাকে একটি ৩২ কোল্ট রিভলবার, যেটির ব্যবহার ছিল অত্যন্ত বিরল।
নয় বছর বয়সে বাবা-মার মৃত্যুর পর থেকে তিনি তোপসের বাবা-মার কাছেই বড়ো হন। তাঁর পিতার নাম জয়কৃষ্ণ মিত্র। তিনি ছিলেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে গণিত আর সংস্কৃতের মাস্টারমশাই। গোয়েন্দাগিরি শুরুর আগে ফেলুদাও একটি স্কুলে কিছুদিন পড়িয়েছেন। স্কটিশচার্চ কলেজের প্রাক্তন এই ছাত্রটি পড়ানোকে খুবই উপভোগ করতেন। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, যোগব্যায়াম করা ইত্যাদি সুঅভ্যাসের পরিচয় তাঁর চরিত্রে মেলে। আবার দেখা যায়, পান ও সিগারেটের প্রতি তার আসক্তি রয়েছে। ভালো লোভনীয় খাবার, ভালো সাজ, বই ও সিনেমার প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক দেখা যায়। ফেলুদা কাহিনির অন্যান্য বহু চরিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিধু জ্যাঠা, হরিপদ, মগনলাল মেঘরাজ, পুলক ঘোষাল, শ্রীনাথ, ভরদ্বাজ, বৈকুন্ঠ মল্লিক প্রমুখ। ফেলুদা কাহিনির মধ্যে ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’, ‘বাদশাহী আংটি’, ‘কৈলাস চৌধুরীর পাথর’, ‘শেয়াল দেবতা রহস্য’, ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘বাক্স রহস্য’, ‘সমাদ্দারের চাবি’, ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’, ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’, ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’, ‘গোসাইপুর সরগরম’, ‘গোরস্থানে সাবধান’, ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’, ‘হত্যাপুরী’, ‘গোলকধাম রহস্য’, ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’, ‘নেপোলিয়ানের চিঠি’, ‘টিনটোরেটোর যীশু’, ‘অম্বরসেন অন্তর্ধান রহস্য’, ‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’, ‘এবার কান্ড কেদারনাথে’, ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’, ‘দার্জিলিং জমজমাট’, ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’, ‘অপ্সরা থিয়েটার মামলা’, ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’, ‘গোলাপীমুক্তা রহস্য’, ‘লন্ডনে ফেলুদা’, ‘ড. মুন্সীর ডায়ারি’, ‘নয়ন রহস্য’, ‘রবার্টসনের রুবি’, ‘ইন্দ্রজাল রহস্য’, ‘তোতা রহস্য’, ‘আদিত্য বর্ধনের আবিষ্কার’ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
টেনিদা চরিত্রের জীবনী নির্মাণ
আমাদের শৈশব কৈশোর কেটেছে টেনিদার সাথে, পটলডাঙা স্ট্রিটের সেই রোয়াকের ফুরফুরে আড্ডার আমেজ নিয়ে, টেনিদাই আমাদের অবিসংবাদী নায়ক। তাঁর সহযোগী অথবা ‘অ্যাসিসটেন্ট’ ক্যাবলা, হাবুল আর প্যালারাম। আর তার সাথে আমরা অর্থাৎ প্রত্যেক কিশোর বাঙালি মন। ‘টেনিদা’ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-সৃষ্ট এক কালজয়ী চরিত্র। পোশাকে, খাদ্যাভ্যাসে, অবসর বিনোদনে, চিত্ত-চেতনায়, ভয়ভীতিতে, মুখের বড়ো বড়ো বুলিতে টেনিদা যেন একই সাথে প্রত্যেক বাঙালির প্রতিনিধিত্ব করে। টেনিদা সমগ্র-এর ‘সংকলকের নিবেদন’ অংশে প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় যথার্থই মন্তব্য করেছেন-“…নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটোদের লেখামাত্রই দারুণ উপভোগ্য। কিন্তু টেনিদার ক্ষেত্রে তার মাত্রাটা যেন কূল- ছাপানো। প্রেমেন্দ্র মিত্রের যেমন ঘনাদা, পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায়ের যেমন ফেলুদা, তেমনই এক পরম পাঠকপ্রিয় চরিত্র টেনিদা। টেনিদার সঙ্গে ঘনাদার মিল নেই, ফেলুদা তো গোয়েন্দা চরিত্র, টেনিদা একেবারে টেনিদারই মতন। এক এবং অদ্বিতীয়। টেনিদার মুখের কথা আজ প্রবচন, পটলডাঙার চারমূর্তির কীর্তিকাহিনি আজ কিংবদন্তি।”
‘টেনিদা’ সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘চারমূর্তি’, প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে। গ্রন্থের ভূমিকাংশে লেখক লিখেছেন-“ছোটদের একটুখানি খুশি কররার আশা নিয়ে ‘চারমূর্তি’ ধারাবাহিকভাবে শিশুসাথী-তে লিখেছিলাম, ছোটোরা আশাতীতভাবে সাড়া দিয়েছে। সেই ভরসাতেই বইয়ের আকারে প্রকাশ করা গেল। চারমূর্তির অভিযান বইয়ের ভূমিকায় লেখক প্যালারামের জবানিতে একটি ভূমিকা লেখেন। প্রাসঙ্গিক মনে করে তা এখানে উদ্ধৃত করছি-ছোট ছোট বন্ধুরা,
পটলডাঙার ‘চারমূর্তি’ এখন বড়ো হয়েছে, তারা কলেজে পড়ছে। তাই সেদিন টেনিদা এসে শাসিয়ে বললে, ‘দ্যাখ প্যালা আমাদের কীর্তি কাহিনী নিয়েই যেসব উপন্যাস লিখছিস, তাতে লোকের কাছে আর মান থাকবে না। ফের যদি তুই আমাদের নিয়ে উপন্যাস লিখবি তাহলে এক চড়ে তোর নাক নাসিকে পাঠিয়ে দেব। ‘হাবুল যেন সঙ্গে সঙ্গে বললে ‘হ সত্য কইছ’ আর ক্যাবলা দয়া করে বললে “মধ্যে মধ্যে দু-একটা গল্প লিখতে পারিস-নইলে অভ্যুদয়ের অমিয় চক্রবর্তী আবার রাগ করবে।’ মাথা চুলকে বললুম, ‘তথাস্তু’।”
তোমরা তো টেনিদাকে জানোই। আমি রোগা-পটকা প্যালারাম- তাকে চটাতে পারি? তাই ‘চারমূর্তি’কে নিয়ে আর উপন্যাস নয়, কখনো কখনো গল্প তোমাদের নিশ্চয় শোনাবো, কী করি বলো? প্রাণের মায়া আছে তো একটা! তোমাদের প্যালারাম।”
যদিও এর পরবর্তীতে টেনিদার এই ভীতিপ্রদর্শন কাজ দেয়নি। কারণ, ‘ঝাউবাংলোর রহস্য’ উপন্যাসটি ছাপা হয় ‘সন্দেশ’-এ। চারমূর্তির প্রত্যেকের একটি করে অপূর্ব পোশাকি নাম আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে সেগুলোও। দেখি ঠিক ঠিক বলতে পারি কি না-টেনিদা আসলে ভজহরি মুখার্জি, স্বর্নেন্দু সেন হচ্ছে ঢাকাইয়া হাবুল, কুশল মিত্রই আসলে ক্যাবলা আর প্যালারাম হচ্ছে গিয়ে কমলেশ ব্যানার্জি।
এরা সবাই আসলে আমাদের বন্ধু-বান্ধব, হাসি-মজা, ঠাট্টা আর অন্তহীন কৌতুকের সুপ্ত প্রান্তরে এদের সাথে প্রাণের আলাপ। এদের নিয়ে রচিত বিচিত্ররসের অজস্র কাহিনিতে লেখক কৌতুকের নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। টেনিদার সংলাপে ‘কুরুবকের মতো বকবক করা, কান ছিঁড়ে কানপুরে পাঠানো, দাঁতনে দাঁত পাঠানো, নাসিকে নাক পাঠানো, পুঁদিচ্চেরি (যার অর্থ ব্যাপারটা খুব ঘোরালো) ইত্যাদির বিশিষ্ট প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। এমনই কৌতুককর সংলাপের অবতারণায়, অসংলগ্ন আর পূর্বাপর সম্পর্করহিত তথ্যের উপস্থাপনায় বানিয়ে তোলা গল্পের মেজাজটিকে লেখক অক্ষুণ্ণ রাখেন।
টেনিদা আর তার সঙ্গীদের অনবদ্য পরিচয় ফুটে উঠেছে ‘চারমূর্তি’, ‘চারমূর্তির অভিযান’, ‘কম্বল নিরুদ্দেশ’, ‘টেনিদা আর সিন্ধুঘটক’, ‘ঝাউ- বাংলোর রহস্য’ প্রভৃতি উপন্যাসে; ‘একটি ফুটবল ম্যাচ’, ‘দধীচি, পোকা ও বিশ্বকর্মা’, ‘খট্টাঙ্গ ও পলান্ন’, ‘মৎস্য পুরাণ’, ‘পেশোয়ার কী আমীর’, ‘কাক- কাহিনী’, ক্রিকেট মানে ঝিঁঝি’, ‘পরের উপকার করিও না’, ‘চেঙ্গিস আর হ্যামলিনের বাঁশিওলা’, ‘ঢাউস’, ‘নিদারুণ প্রতিশোধ’, ‘তত্ত্বাবধান মানে জীবে প্রেম’, ‘দশানন চরিত্র’, ‘দি গ্রেট ছাঁটাই’, ক্যামোফ্লেজ’, ‘কুট্টিমামার হাতের কাজ’, ‘সাংঘাতিক’, ‘বন-ভোজনের ব্যাপার’, ‘কুট্টিমামার দন্ড-কাহিনী’, ‘প্রভাব সঙ্গী’, ‘ভজহরি ফিল্ম কর্পোরেশন’, ‘চামচিকে আর টিকিট চেকার’, ‘ব্রাহ্মবিকাশের দত্তবিকাশ’, ‘টিকটিকির ল্যাজ’, ‘বেয়ারিং ছাঁট’, ‘কাঁকড়াবিছে’, ‘হনোলুলুর মাকুদা’, ‘হালখাতার খাওয়া দাওয়া’, ‘ঘুঁটেপাড়ার সেই ম্যাচ’, ‘টেনিদা আর ইয়েতি’, ‘একাদশীর রাঁচি যাত্রা’, ‘ন্যাংচাদার হাহাকার’ প্রভৃতি গল্পে ও ‘পরের উপকার করিও না’ শীর্ষক নাটকে।