আমার জীবন-কাহিনি
(হেলেন কেলার)
১৮৯৬ সালে র্যাডক্লিফ কলেজে ভরতি হবার প্রস্তুতি হিসেবে আমি কেম্ব্রিজ স্কুল ফর ইয়ং লেডিজ-এ ভরতি হলাম। আমি যখন খুব ছোটো ছিলাম তখন ওয়েলেসলিতে গিয়ে বন্ধুদের এই বলে তাক লাগিয়ে দিতাম, “একদিন আমি কলেজে ভরতি হব, কিন্তু যাব হার্ভার্ড- ৪। অন্য কোথাও না।’ যখন জিজ্ঞাসা করা হল কেন আমি ওয়েলেসলি কলেজে যেতে অনিচ্ছুক, আমি জবাব দিয়েছিলাম, “কারণ ওখানে শুধুই মেয়েরা পড়ে।” কলেজে যাবার বাসনা আমার মনে দৃঢ়মূল হয়েছিল, একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর এই আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক ইন্দ্রিয়শক্তিসম্পন্ন অর্থাৎ দেখতে আর শুনতে পায় এমন মেয়েদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে আমাকে প্রবুদ্ধ করেছিল। আমার অনেক যথার্থ আর বিচক্ষণ বন্ধু এর থেকে আমাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেও আমি হাল ছেড়ে দিইনি। নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরে আসার সময় এই ইচ্ছেটাই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিকই হয়ে গিয়েছিল যে আমি কেম্ব্রিজে জরতি হব। হার্ডার্ড-ও যাওয়ার স্বপ্নের এটিই ছিল নিকটতম রূপায়ণ, আমার ছোটোবেলার সদর্প ঘোষণার পরিপূর্তির নিকটতম রূপ।
পরিকল্পনা ছিল মিস সালিজ্ঞাণ্ড আমার সঙ্গে কেম্ব্রিজ স্কুলে ক্লাসে যাবেন এবং যে শিক্ষা ক্লাসে দেওয়া হবে তা উনি আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেবেন।
অবশ্য স্বাভাবিক ইন্দ্রিয়শক্তিসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ছাড়া অন্য কাউকে পড়ানোর অভিজ্ঞতা আমার স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছিল না। আর তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার আমার একমাত্র উপায় ছিল ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে তাঁদের কথা বোঝা। প্রথম শিক্ষাবর্ষে আমার পাঠা বিষয়গুলির মধ্যে ছিল ইংল্যান্ডের ইতিহাস, ইংরেজি সাহিত্য, জামান ও ল্যাটিন ভাষা, পাটিগণিত, ল্যাটিন রচনা এবং বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান বা ঘটনাকেন্দ্রিক রচনা। তখন পর্যন্ত কলেজের উপযোগী কোনো পাঠক্রম আমি অনুসরণ করিনি; কিন্তু মিস সালিজান্ আমাকে বেশ ভালো করেই ইংরেজি শিখিয়েছিলেন। আমার নতুন শিক্ষকদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে বিশ্লেষণ করে পড়ার জন্য নির্বাচিত পাঠ্য বইগুলো ছাড়া ইংরেজিতে আর কোনো বিশেষ বা আলাদা শিক্ষার আমার দরকার ছিল না। তা ছাড়া ফরাসি শেখায় আমার শুরুটা ভালোই হয়েছিল এবং লাতিন ভাষাতেও আমি এর আগে ছ-মাস তালিম পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার ঘনিষ্ঠতম পরিচয় হয়েছিল জার্মান ভাষার সঙ্গে।
কিন্তু এইসব সুবিধা সত্ত্বেও আমার লেখাপড়ায় এগোনোর পথে একাধিক বাধা ছিল। মিস সালিজান্ আমার নতুন পাঠ্যবিষয়গুলির জন্য দরকারি সব কিছু শব্দ বা চিন্তা হাতে বানান করে দেখাতে পারতেন না। আর হাতে যা সময় ছিল তার মধ্যে সবগুলো বই উঁচু ব্রেইল হরফে ছেপে নেওয়াও সম্ভব ছিল না, যদিও লন্ডন আর ফিলাডেলফিয়ার বন্ধুরা তাড়াতাড়ি কাজটা করে দিতে তৈরি ছিলেন। বাস্তবিক, কিছুদিন আমাকে নিজেকেই আমার ল্যাটিন পাঠ্যসূচি ব্রেইল-এ কপি করে নিতে হয়েছিল যাতে অন্য মেয়েদের সঙ্গে আমিও সেগুলো আবৃত্তি আর ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারি। শীঘ্রই আমার অধ্যাপকেরা আমার উচ্চারণ ত্রুটিপূর্ণ হলেও তা বুঝতে শুরু করলেন, যার ফলে আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আর আমার উত্তরের ভুল শুধরে দেওয়া তাঁদের পক্ষে সহজ হয়ে এল। আমি ক্লাসে বসে নোট নিতে বা exercise- গুলোর উত্তর করতে পারতাম না; কিন্তু যাবতীয় রচনা আর অনুবাদের কাজ আমি বাড়িতে টাইপরাইটারে করতাম।
মিস সালিড্যান্ আমার সঙ্গে রোজ ক্লাসে যেতেন আর অসীম ধৈর্য নিয়ে অধ্যাপকেরা যা কিছু বলতেন আমার হাতে বানান করে দেখাতেন। পাঠ তৈরি করার জন্য যে সময় পাওয়া যেত তাতে তিনি নতুন করে শব্দগুলো অভিধানে দেখে নিতেন। যেসব নোট আর বই উঁচু ব্রেইল হরফে পাওয়া যেত না সেগুলি নিজে একাধিকবার পড়তেন আমাকে সঠিক বোঝানোর জন্য। এই একঘেয়ে কাজ তাঁর পক্ষে কী ক্লান্ডিকর ছিল তা সবাই বুঝবে না। সমগ্র কলেজের মধ্যে শুধু দুজন-আমার জার্মান ভাষার শিক্ষয়িত্রী ফ্রাউ প্রয়েটে আর অধ্যক মি. গিলম্যান-আমাকে শিক্ষা দেওয়ার সুবিধার জন্য আঙুলে বর্ণমালা লেখার পদ্ধতি শিখে নিয়েছিলেন। ফ্রাউ গ্রয়েটের এই বানান করার পদ্ধতি কত মখর গতিতে চলত আর আমার প্রয়োজনের পক্ষে কত অপ্রতুল ছিল তা তাঁর হেয়ে বেশি আর কেউ জানতেন না; কিন্তু তিনি যেটুকু পারতেন তা আন্তরিকতার সঙ্গে করতেন এবং সপ্তাহে দু-বার অতিরিক্ত ক্লাস নিতেন, যাতে মিস সালিজ্ঞানের একটু বিশ্রাম হয়। যদিও সকলে আমার প্রতি সদয় আর আমাদের সাহায্য করতে সব সময়ে প্রস্তুত ছিলেন, তবুও, কেবল একজনই ছিলেন যিনি ক্লান্তিকর কর্তব্যকে আনন্দে পরিণত করতে পারতেন।
সে বছর আমি পাটিগণিত শেষ করলাম, ল্যাটিন ব্যাকরণও আবার ঝালিয়ে নিলাম আর সিজারের “Gallic War”” বইটির তিনটি অধ্যায় শেষ করলাম। এই সময় কিছুটা ব্রেইল হরফে ছাপা বইয়ে আঙুল বুলিয়ে আর বাকিটা সালিজ্ঞানের সাহায্যে আমি জার্মান ভাষায় লেখা অনেক বই পড়ে ফেলেছিলাম। সেগুলির মধ্যে ছিল শিলারের” “Lied von der Glocke” এবং “Taucher”, হাইনের” “Harzreise”, ফ্রেস্টালের” “Aus dem Staat Friedrichs des Grossen”, রিলের” “Fluch Der Schönheit”, লেসিং- “Minna von Barnhelm” এবং গ্যেটের” “Aus meinem Leben” এই জার্মান বইগুলি পড়ে আমি পরম আনন্দ পেয়েছি-বিশেষ করে পিলারের অদ্ভুত গীতিকবিতা, ফ্রেডরিক দ্য গ্রেটের নানা মহৎ কীর্তির কাহিনি আর গ্যেটের জীবনকথা পড়ে। যখন হাইনের Die Harzreise পড়া শেষ হয়ে গেল তখন আমার বেশ মন খারাপ হল। তাঁর ওই মজার সব উক্তি, আঙুরলতায় হাওয়া পাহাড়ের মনোহর বন্ধুনা, সূর্যের আলোয় গান গাইতে গাইতে প্রবহমান সব নদীর কথা, ইতিহাসপ্রসিদ্ধ সব অরণ্যানীর কাহিনি, কল্পনার যুগের আলো-অন্ধকারে মেশানো আবছা আবছা সেইসব রূপকথার বোনেদের বর্ণনা-যেগুলি তাঁরাই দিতে পারেন যাঁদের কাছে প্রকৃতিদেবী প্রেম, অনুভূতি আর সৌন্দর্যপিপাসারই আর-এক মূর্তি।
ওই বছরের কিছুদিন মি. গিলম্যান আমাকে ইংরেজি সাহিত্য পড়িয়েছিলেন। তাঁর কাছে আমি “As You Like It”, বার্কের” “Conciliation with America” আর মেকলের” “Life of Samuel Johnson” পড়েছিলাম। যান্ত্রিকভাবে ক্লাসের নোট আর ব্যাখ্যাগুলো পড়ার চেয়ে ইতিহাস ও সাহিত্য সম্বন্ধে মি. গিলম্যানের উদার চিন্তা আর তাঁর মনোগ্রাহী ও মৌলিক ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আমার সাহিত্য পড়ার কাজকে অনেক বেশি সহজ আর আনন্দদায়ক করে তুলেছিল।
রাজনৈতিক বিষয়ে আমি যেসব লেখা পড়েছিলাম তার মধ্যে বার্কের ভাষণ আমার কাছে বিশেষ শিক্ষাপ্রদ ছিল। তাঁর যুগের উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক আবহাওয়া আমাকেও চঞ্চল করে তুলত। আর যেসব চরিয়কে কেন্দ্র করে দুটি মুযুধান জাতির ভাগ্য আবর্তিত হত আমার সামনে যেন তারা জীবন্ত হয়ে উঠত। বার্কের অদ্ভুত শক্তিশালী বক্তৃতা যখন ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে আমার দিকে এগিয়ে আসত তখন ভেবে আশ্চর্য হতাম কী করে রাজা তৃতীয় জর্জ আর তাঁর মন্ত্রীরা মার্কিন জাতির অবশান্তাবী জয় আর তাঁদের নিজেদের অবমাননাকর পরাজয় সম্বন্ধে বার্কের সর্তকবাণী উপেক্ষা করতেন। তারপর – পাঠ করলাম এই মহান রাষ্ট্রনেতা আর জনগণের প্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর নিজের রাজনৈতিক দলের মনোমালিন্যের বিষাদময় কাহিনি। আমি ডেবে অবাক হতাম কীভাবে তিনি অজ্ঞতা ও দুর্নীতির মাঝেও তাঁর সত্য ও প্রজ্ঞার
মহামূল্য বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। মেকলের অন্য দিক থেকে আমার আগ্রহ জাগিয়েছিল। যে নিঃসঙ্গ মানুষটি তাঁর দুঃখের দিনগুলো গ্রাব স্ট্রিট-এ কাটিয়েছিলেন তাঁর প্রতি সহানুভূতি আমার হৃদয়কে বাথিত করেছিল। অবাক লাগে, ওই কঠোর পরিশ্রম আর তাঁর নিজের অসহ্য শারীরিক অসুস্থতা আর মানসিক যন্ত্রণা নিয়েও ওই মানুষটি (ড. স্যামুয়েল জনসন) = উপেক্ষিত দরিদ্র মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে কখনও ডোলেননি। তাঁর জীবনের পরবর্তী সময়ে তাঁর সমস্ত সাফল্য আমাকে আনন্দিত • করেছিল। তাঁর চরিত্রের ত্রুটিগুলো আমার চোখেই পড়ত না। তাঁর চরিয়ে যা কিছু দোষ ছিল তার কথা চিন্তা করে আমি আশ্চর্য হতাম না, শুধু অবাক হতাম এই ভেবে যে, ওই দোষগুলো তাঁর আত্মার মহত্বকে ধবংস করতে বা অধঃপতিত করতে পারেনি। কিন্তু (ড. জনসনের) চরিত্রচিত্রণে মেকলে যতই তাঁর বুদ্ধিগত ঔজ্জ্বল্য দেখিয়ে থাকুন না কেন, যতই সাধারণ সব ব্যাপারকে প্রশংসনীয়ভাবে চিত্রধমী ও প্রাণবন্ত করে তুলুন না কেন, তাঁর (অর্থাৎ মেকলের) অতিরিক্ত আযপ্রত্যয় আমাকে মাঝে মাঝে বিরক্ত করত। রচনার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তিনি (অর্থাৎ মেকলে) যে কখনো-কখনো সত্যকে বিসর্জন দিতেন তা আমার মনে সন্দেহ জাগাত, যে সন্দেহ গ্রেট ব্রিটেনের ডেমস্থেনিস, বার্কের কথা শোনার সময় কোনোদিন আমার মনে জাগেনি।
আরও পড়ুন: একাদশ শ্রেণী সটীক অনুবাদ প্রজেক্ট বিষম সমস্যা গল্প
দেখতে এবং শুনতে পায় এমন কতকগুলি মেয়ের সঙ্গ আমি প্রথম কেট্রিজ স্কুলে পেয়েছিলাম। আরও কয়েকটি এইরকম মেয়ের সঙ্গে আমি স্কুলের খুব – কাছেই একটি মনোরম বাড়িতে থাকতাম, যেখানে মি. হাওয়েস্ থাকতেন। এখানে নিজের বাড়ির সব রকম আরাম পাওয়া যেত। আমি তাদের অনেক রকম খেলায় যোগ দিতাম, এমনকি লুকোচুরি আর বরফে ছুটোছুটিতেও; তাদের সঙ্গে অনেক দূরে নানা জায়গায় বেড়াতে যেতাম; আমাদের লেখাপড়া নিয়ে আলোচনা করতাম, আর মনের মতো লেখাগুলো পরস্পরকে পড়ে শোনাতাম। এই মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতেও শিখেছিল, এর ফলে তাদের কথা আবার মিস সালিড্যানের বানান করে বোঝাবার দরকার হত না।
আমার মা ছোটোবোনকে নিয়ে আমার কাছে এসে বড়োদিন কাটালেন। মিলড্রেড্ যাতে তাঁর স্কুলে পড়তে পারে তার ব্যবস্থা করতে মি. গিলম্যান রাজি হলেন। তাই সে আমার কাছে কেম্ব্রিজেই থেকে গেল আর দুটো আনন্দময় মাস আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাটালাম। যখন মনে পড়ে দুজনে কীভাবে পরস্পরকে সাহায্য করতাম আর পড়াশোনা করতাম, তখন আনন্দে মন ভরে যায়।
আমার র্যাডক্লিফ্ কলেজে ঢোকার জন্য প্রথম পরীক্ষা হয় ১৮৯৭ সালের ২৯ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত। প্রাথমিক আর উচ্চ পর্যায়ের জার্মান, ফরাসি, ল্যাটিন, ইংরেজি আর গ্রিক এবং রোমের ইতিহাস-এই কটি বিষয়ে আমি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। মোট ৯ ঘন্টার পরীক্ষা। সব কটি বিষয়েই আমি পাশ করেছিলাম, জার্মান আর ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে।
কী পদ্ধতিতে আমার পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল এখানে তার কিছু বর্ণনা দেওয়াটা বোধহয় অবান্তর হবে না। একজন পরীক্ষার্থীকে মোট যোলো ঘন্টার পরীক্ষা দিতে হত। এর মধ্যে বারো ঘন্টা প্রাথমিক আর চার ঘন্টা উচ্চতর পাঠক্রমের জন্য। তাকে ভরতির অনুমতি পাওয়ার জন্য অন্তত একসঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা পরীক্ষা দিতে হত। প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হত হার্ভার্ডে সকাল ৯-টায় আর সেগুলো একজন বিশেষ বাহক র্যাডক্লিফে নিয়ে। আসতেন। নামের বদলে একটা সংখ্যা দিয়ে পরীক্ষার্থীকে সূচিত করা হত। আমি ছিলাম নং ২৩৩। কিন্তু যেহেতু আমাকে একটা বিশেষ ধরনের টাইপিং মেশিন ব্যবহার করতে হত, তাই আমার ব্যক্তিগত পরিচয় গোপন রাখা যেত না।
সবাই যথার্থই ভেবেছিলেন আমার পরীক্ষাটা এমন একটা ঘরে নেওয়া দরকার যেখানে শুধু আমিই একমাত্র পরীক্ষার্থী থাকব, কারণ আমার টাইপ করার শব্দ অন্য পরীক্ষার্থীদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। মি. গিলম্যান সব প্রশ্নের বানান আমার হাতে লিখে দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে আমার মনোযোগে বাধা না পড়ে, তা দেখার জন্য সব সময়ে একজন। দারোয়ানকে দরজার কাছে রাখা হয়েছিল।
প্রথম দিনে পরীক্ষার বিষয় ছিল জামান ভাষা। আমার পাশে বসে মি. পিলম্যান প্রশ্নগুলির আদ্যোপান্ত পড়ে দিয়েছিলেন। তারপর প্রতিটি বাক্য ধরে ধরে আমিও চেঁচিয়ে উচ্চারণ করেছিলাম, আমি যে, তাঁর কথা ঠিক ঠিক বুঝেছি। তা জানাবার জন্যে। প্রশ্নগুলো বেশ কঠিন ছিল, আর বেশ উদ্বেগ নিয়েই আমি টাইপিং মেশিনে সেগুলির উত্তর লিখেছিলাম। আমি যা লিখছিলাম বি. গিলম্যান তা বানান করে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন, আর প্রয়োজনবোধে আমি সেগুলোর রদবদল করে নিচ্ছিলাম, আর উনিও সেগুলো উত্তরের মধ্যে। ঢুকিয়ে নিচ্ছিলেন। এখানে বলা দরকার যে, এর পরে অন্য কোনো পরীক্ষায়। এই সুবিধেগুলো আমি পাইনি। র্যাডক্লিফ্ কলেজে আমি প্রশ্নপত্রের উত্তর দেওয়ার পর কেউ আর সেগুলো আমাকে পড়ে শোনাত না, ফলে উত্তরে কোনো ভুল থাকলে তা শোধরানোর উপায় থাকত না, যদি না নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই আমার উত্তর দেওয়া শেষ হত। সেক্ষেত্রে যে-ভুলগুলো আমার মনে পড়ত সেগুলো মাত্র সামান্য অতিরিক্ত সময়ের মধ্যে শোধরাতে হত, আর আমার উত্তরপত্রের শেষের দিকে জায়গা থাকলে সেখানে সংশোধনীগুলো লিখে নেওয়া হত। আমি যে প্রাথমিক পরীক্ষাতে পরের পরীক্ষাগুলোর থেকে অনেক বেশি নম্বর নিয়ে পাশ করেছি, তার কারণ দুটি-পরের পরীক্ষাগুলোয় আমার উত্তরগুলো আবার আমাকে পড়ে শোনাবার কেউ ছিলেন না; আর যে-বিষয়গুলোর সঙ্গে আমি ইতিমধ্যেই ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম, কেম্ব্রিজে এসে প্রাথমিক পরীক্ষার জন্য সেগুলিকেই আমি পরীক্ষার জন্য বেছে নিয়েছিলাম। কারণ সে বছরের প্রথম দিকেই আমি ইংরেজি, ইতিহাস, ফরাসি আর জার্মান নিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। আগের কয়েক বছরের হার্ভার্ডের প্রশ্নপত্রের ভিত্তিতে মি. গিলম্যান আমার এই পরীক্ষাগুলি নিয়েছিলেন।
আমার উত্তরসমেত কাগজগুলো যে আমারই, অর্থাৎ পরীক্ষার্থী নং ২৩৩-এর, এই মর্মে একটা সার্টিফিকেট-সমেত মি. গিলম্যান সেগুলো পরীক্ষকদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
অন্য আর সব প্রাথমিক পরীক্ষাগুলোও ঠিক এইভাবে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আর কোনো পরীক্ষাই প্রথমচির মতো আমার কাছে কঠিন লাগেনি। আমার মনে আছে, যেদিন ল্যাটিনের প্রশ্নপত্র আমাদের দেওয়া হল সেদিন অধ্যাপক শিলিং এসে আমাকে জানালেন যে জামান পরীক্ষায় আমি বেশ ভালোভাবে পাশ করেছি। শুনে আমার উৎসাহ বেড়ে গেল, আর হালকা মেজাজে এবং স্থির হাতে লিখে বাকি পরীক্ষাগুলোতেও আমি শেষ পর্যন্ত উতরে গেলাম।