ইন্দ্রজাল রহস্য (সত্যজিৎ রায়) গল্পের চিত্র নাট্যরূপ
নাট্যরূপ: প্রভিরূপ দাস
চরিত্রলিপি: ফেলুদা, লালমোহনবাবু, নিখিল, তোপসে, সোমেশ্বর, সূর্যকুমার, অনিমেষ, প্রণবেশ, শংকর
।। সিন- ১।।
[ রবিবার সকালে লালমোহনবাবু, তোপসে, ফেলুদা বসে গল্প করছে চা খেতে খেতে।]
ফেলুদা: ম্যাজিশিয়ানটা ঠিক জমাতে পারছে না। কালকেও সীট খালি ছিল দেখলি?
লালমোহন: কিন্তু যাই বলুন মশাই, আমাকে যেভাবে যেভাবে বোকা বানালো, তাতে বলতেই হবে কৃতিত্ব আছে। পেনসিল চিবিয়ে চকোলেট, পাথর কামড়ে কড়া পাকের সন্দেশের স্বাদ-এ ভাবা যায় না।
তোপসে: তবে যাই বল ফেলুদা, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির সঙ্গে একটা চুমকি বসানো পাগড়ি আর পাতলা গলার আওয়াজের ম্যাজিশিয়ান এই প্রথম দেখলাম।
[ নিখিলের প্রবেশ ]
নিখিল: আসতে পারি?
ফেলুদা: আজ্ঞে হ্যাঁ আসুন।
নিখিল: [ নিখিল ঘরে এসে। ] টেলিফোনে অনেক চেষ্টা করেও আপনার লাইনটা পেলাম না। তাই এমনিই চলে এলাম।
ফেলুদা: আপনার প্রয়োজনটা যদি বলেন।
নিখিল: আমার নাম নিখিল বর্মন। আমার বাবার নাম হয়তো শুনে থাকবেন-সোমেশ্বর বর্মন।
তোপসে: যিনি ভারতীয় জাদু দেখাতেন?
নিখিল: আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।
ফেলুদা: আজ্ঞে ও আমার ভাইপো তোপসে। আর……
নিখিল: আর ইনি হলেন লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়।
লালমোহন: আজ্ঞে হ্যাঁ। আজকাল তো আপনার বাবার নাম শুনি না। রিটায়ার করেছেন বোধহয়?
নিখিল: হ্যাঁ, বছর সাতেক হল আর ম্যাজিক দেখান না।
ফেলুদা: উনি তো স্টেজে ম্যাজিক দেখাতেন না বোধহয়?
নিখিল: না। এমনি ফরাসে দেখাতেন। ওঁর চারিদিকে লোক ঘিরে বসত। সাধারণত নেটিভ স্টেটগুলোতে ওর খুব নাম ছিল। বহু রাজাদের ম্যাজিক দেখিয়েছেন। তা ছাড়া, বাবা নানান দেশে ঘুরে ভারতীয় ম্যাজিক সম্বন্দ্বে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। সেগুলো একটা বড়ো খাতায় লেখা আছে। বাবা ইংরাজিতে লিখেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘ইন্ডিয়ান ম্যাজিক’। ওটা একজন কিনতে চেয়েছেন বাবার কাছে। কুড়ি হাজার টাকা পর্যন্ত অফার করেছেন। বাবা চাইছিলেন আপনাকে একবার লেখাটা দেখাতে। কারণ বারা ঠিক মনস্থির করতে পারছেন না।
ফেলুদা: কে কুড়ি হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন জানতে পারি?
নিখিল: জাদুকর সূর্যকুমার নন্দী। আশ্চর্য। কালই তো আমরা সূর্যকুমারের ম্যাজিক দেখে এলাম। ফেলুদা একেই বলে টেলিপ্যাথি।
তোপসে: বেশ, আমি লেখাটা নিশ্চই দেখব। তা ছাড়া, আপনার বাবার সঙ্গে আমার আলাপ করারও যথেষ্ট ইচ্ছে আছে।
নিখিল: বাবাও আপনার খুব গুণগ্রাহী। বলেন, অমন শার্প বুদ্ধি বাঙালিদের বড়ো একটা দেখা যায় না।
ফেলুদা: আমার মনে হয়, এর মধ্যেই একদিন এসে পড়ুন না। বাবা সন্ধ্যায় রোজই বাড়ি থাকেন।। ঠিক আছে। আমরা আজ সন্ধ্যাতেই তাহলে আসি।
নিখিল: বেশ তো। এই সাড়ে ঘটা নাগাদ।
ফেলুদা: তাই কথা রইল।
কাট্
।। সিন ২।।
[ সোমেশ্বরবাবুর বাড়িতে ফেলুদা, নিখিল, জটায়ু, তোপসে-র প্রবেশ।]
নিখিল: বাবা দেখুন কারা এসেছেন।
সোমেশ্বর: আরে আপনারা। আসুন আসুন। আমার কী সৌভাগ্য যে আপনারা এখানে এসেছেন
ফেলুদা: না না এসব কী বলছেন? আমরা যদি না আসতাম তাহলে আপনার সঙ্গে আলাপ হত কী করে। আপনাকে আলাপ করিয়ে দি-এ হল আমার ভাইপো তোপেস, আর ইনি হলেন আমার বিশিষ্ট বন্ধু বিখ্যাত সাহিত্যিক লালমোহন গাঙ্গুলি।
নিখিল: বাবা, আপনারা কথা বলুন, আমি চা আর মিষ্টি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
[ নিখিলের প্রস্থান ]
ফেলুদা: হ্যাঁ, আপনার ব্যাপারে কিছু বলুন।
সোমেশ্বর: আমার বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। ভালো পসার ছিল। আমি ল পড়েছিলাম কিন্তু সেইদিকে যাইনি। আমার ঠাকুরদা ছিলেন তান্ত্রিক, তাই হয়তো তাঁরই কিছুটা প্রভাব আমার চরিত্রে পড়েছিল। আমার ছেলেবেলা থেকেই ভারতীয় জাদুবিদ্যায় ঝোঁক ছিল। এলাহাবাদের পার্কে এক বুড়োর ম্যাজিক দেখেছিলাম। তার হাত সাফাইয়ের তুলনা হয় না। মধ্যে বেশির ভাগ ম্যাজিকই আজ যন্ত্রের সাহায্যে হয়। সেইজন্যে তাতে আমার ইন্টারেস্ট নেই। ভারতীয় ম্যাজিকই হল আসল ম্যাজিক, যেখানে মানুষের দক্ষতাই প্রকাশ পায়। তাই আমি পড়া শেষ করে এই সব ম্যাজিক সংগ্রহ করতে বেড়িয়ে পড়ি। [ ভৃত্য চা ও মিষ্টি রেখে যায়। ফেলুদা হাতে চায়ের কাপ তুলে নেন।।
ফেলুদা: এবার আপনার পান্ডুলিপির কথা বলুন। শুনেছি, ভারতীয় জাদু নিয়ে আপনি একটা বড়ো কাজ করেছেন।
সোমেশ্বর: তা করেছি। আমি যা করেছি তেমন আর কেউ করেছে বলে আমার মনে হয় না। এ নিয়ে প্রবন্ধ-টবন্ধও লিখেছি এবং তার ফলেই আমার পাণ্ডুলিপির ব্যাপারটাও জানাজানি হয়ে গেছে। সে কারণেই সূর্যকুমার আমার কাছে আসে। নইলে তার তো জানার কথা নয়। অবশ্য জাদুকর হিসেবে আমার নাম আগেই শুনেছে।
ফেলুদা: সে কি আপনার পাণ্ডুলিপিটা কিনতে চায়?
সোমেশ্বর: তাই তো বলে। সে সোজা আমার বাড়িতে চলে এসেছিল। আমার বেশ ভালো লাগে ছেলেটিকে। দেখে কেমন একটা স্নেহ পড়ে গেছিল। কিন্তু ওর অফারটায় আমি ঠিক রাজি নই। আমার ধারণা এই কাজটা খুব প্রয়োজনীয় এবং তার মূল্য বিশ হাজারের চেয়ে অনেক বেশি। সেইজন্যই চাইছিলাম। যে পান্ডুলিপিটা আপনি পড়ে দেখুন। আপনার তো নানান বিষয়ে পড়াশুনো আছে। সেটা আপনার কেসগুলো পড়ে দেখলে বোঝা যায়।
ফেলুদা: বেশ তো। আমি সাগ্রহে পড়ব আপনার লেখা।
সোমেশ্বর: [ ডাক দিয়ে ] প্রণবেশ, আমার খাতাটা একবার নিয়ে এসো।
তোপসে: আমরা কাল সূর্যকুমারের ম্যাজিক দেখতে গিয়েছিলাম।
সোমেশ্বর: কেমন লাগল?
তোপসে: মোটামুটি। তবে ভদ্রলোক হিপনোটিজমটা বেশ আয়ত্ত করেছেন। আর যা ম্যাজিক সবই যন্ত্রের কারসাজি।
লালমোহন: আপনি যদি একটা ম্যাজিক দেখান তো আমরা খুবই আনন্দিত হব।
সোমেশ্বর: ঠিক আছে। [ টেবিল থেকে পেন তুলে ] এই দেখুন পেনটা আমার হাতে আছে। এবার দেখুন পেনটা আর নেই।
লালমোহন: পেনটা কোথায় গেল?
সোমেশ্বর: প্রদোষবাবু আপনার পকেটে হাত দিয়ে দেখুন তো পেনটা আছে কিনা?
ফেলুদা: [ ফেলুদা পকেটে হাত দিয়ে ] আজ্ঞে হ্যাঁ।
লালমোহন: আপনার অসাধারণ প্রতিভা। আপনার মশাই কোনো জবাব নেই।
[ প্রণবেশের প্রবেশ ]
সোমেশ্বর: এই নিন খাতা নিয়ে এসেছে।
ফেলুদা: [ খাতাটা নিয়ে ] তাহলে আমরা আসি এবার।
সোমেশ্বর: আচ্ছা আসুন।
আরও পড়ুন: নির্বাচিত সাহিত্যিকের সাহিত্য অবদান সম্পর্কিত প্রকল্প নির্মাণ
কাট্
।। সিন- ৩।।
[ ফেলুদা ফোনে কথা বলছে। তোপসে ও জটায়ু বসে আছেন।]
ফেলুদা: হ্যালো, হ্যাঁ বলুন স্যার, তাই নাকি। খুব ভালো।
তোপসে: ফেলুদা কী হল? কী ভালো খবর?
ফেলুদা: সোমেশ্বরবাবু তাঁর পাণ্ডুলিপিটা সূর্যকুমারকে বিক্রি করছেন।
তোপসে: সে তো খুব ভালো কথা।
লালমোহন: আমার জাদুকর নিয়ে একটা ভালো প্লট মাথায় এসেছে, ভাবছিলাম সূর্যকুমারের সঙ্গে কী করে একটু কথা বলা যায়।
ফেলুদা: ওকে হোটেলে ফোন করুন। কোন্ হোটেলে সে আছে সেতো যারা আমাদের টিকিট দিয়েছিল, তারাই বলে দেবে।
লালমোহন: তা বটে। যাই গিয়ে জানি কোন্ হোটেলে সে আছে।
[ পরদিন সকালে ফেলুদার বাড়িতে সূর্যকুমারের আগমন।]
ফেলুদা: আরে আসুন আসুন, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। বসুন।
সূর্যকুমার: আপনার পরিচয়টা পেতে পারি কি? আপনাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।
ফেলুদা: আমি প্রদোষ মিত্র। খবরের কাগজে হয়তো ছবি দেখে থাকবেন।
সূর্যকুমার: আমার পরম সৌভাগ্য।
ফেলুদা: সৌভাগ্য তো আমারও। আপনার মতো দক্ষ ম্যাজিশিয়ানের পায়ের ধুলো পড়ল আমাদের বাড়িতে, সে-ও কি কম সৌভাগ্য
লালমোহন: আপনি কদিন ম্যাজিক দেখাচ্ছেন।
সূর্যকুমার: তা বারো বছর হল।
লালমোহন: কাবুর কাছে শিখেছেন?
সূর্যকুমার: আমি নক্ষত্র সেন ঐন্দ্রজালিকের সহকারী ছিলাম পাঁচ বছর। তাঁর বয়স হয়েছিল-স্টেজেই ম্যাজিক দেখাতে দেখাতে স্ট্রোক হয়ে মারা যান। তাঁর সব ম্যাজিকের সরঞ্জাম আমার হাতে পড়ে। আমি তাই দিয়েই শুরু করি।
লালমোহন: আপনাকে কী সারা ভারতবর্ষ ঘুরে খেলা দেখাতে হয়।
সূর্যকুমার: হ্যাঁ, শুধু ভারতবর্ষ কেন, আমি জাপান আর হংকংও গেছি।
লালমোহন: বটে?
সূর্যকুমার: আজ্ঞে হ্যাঁ। আগামী বছরে সিঙ্গাপুর থেকে নেমন্তন্ন এসেছে।
লালমোহন: আপনার ফ্যামিলি নেই।
সূর্যকুমার: না। আমি ব্যাচেলার।
লালমোহন: এখনও ম্যাজিকের অভ্যাস করতে হয়, না আর দরকার হয় না।
সূর্যকুমার: এখনো সকালে দু-ঘণ্টা হাত-সাফাই প্র্যাকটিস করি। ওটা থামালে চলে না।
ফেলুদা: আপনার সঙ্গে সোমেশ্বর বর্মনের বোধহয় আলাপ হয়েছে।
সূর্যকুমার: আজ্ঞে হ্যাঁ।
ফেলুদা: আপনি তো ভারতীয় জাদুবিদ্যার পান্ডুলিপিটা কিনতে চেয়েছিলেন।
সূর্যকুমার: হ্যাঁ।
ফেলুদা: কেন?
সূর্যকুমার: আমি ভেবেছিলাম আমার বিলিতি ম্যাজিকের মধ্যে কয়েকটা দিশি ম্যাজিক ঢোকাতে পারলে অ্যাট্রাকটিভ হবে। কিন্তু ভদ্রলোক বই বিক্রি করলেন না। আমি বিশ হাজার টাকা অফার করেছিলাম। তবে বিক্রি না করলেও ওঁর সঙ্গে আমার একটা খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, কারণ আমি ওঁকে সত্যিই শ্রদ্ধা করি। উনি আমার শো শেষ হলে পর ওঁর বাড়িতে গিয়ে আমাকে কয়েকদিন থাকতে বলেছেন।
ফেলুদা: আপনার শো কবে শেষ হচ্ছে?
সূর্যকুমার: এই রবিবার।
ফেলুদা: এরপর কোথায় যাওয়া
সূর্যকুমার: দিন সাতেক বিশ্রামের পর পাটনা যাব।
তোপসে: আপনার বাড়ি কোথায়?
সূর্যকুমার: আমার আদি বাড়ি হল ঢাকায়। এখন শ্রীরামপুর অশ্বলে থাকি।
তোপসে: ও……….
সূর্যকুমার: আচ্ছা আমি তাহলে আসি?
ফেলুদা: জলখাবারটা তো খেয়ে যান।
সূর্যকুমার: না না আমার শো আছে, আমাকে যেতে হবে।
ফেলুদা: আর কী বলব। আসুন তাহলে।
[ সূর্যকুমারের প্রস্থান]
ফেলুদা: বিদেশি জামাকাপড় জুতো পড়েছে। বোধহয় জাপান কিংবা হংকং-এ কেনা। এমনিতে বেশ শৌখিন লোক, যেমন ম্যাজিশিয়ানরা হয় সাধারণত।
লালমোহন: সোমেশ্বরবাবুদের সঙ্গে বেশ জমিয়ে নিয়েছেন বলুন? নইলে আর বাড়িতে এসে থাকতে বলে।
কাট্
।। সিন ৪।।
[ এক সপ্তাহ পরে একদিন সকালে বসে ফেলুদা, তোপসে ও লালমোহন বাবু চা খাচ্ছেন।]
তোপসে: ফেলুদা, তুমিতো হাত সাফাই করতে পার। আমাকেও একটু শিখিয়ে দাও না।
লালমোহন: সেকি! আপনি জাদু জানেন তা তো জানতাম না।
তোপসে: ফেলুদা সব পারে। যাকে এককথায় অলরাউন্ডার বলে।’
[ এমন সময় সোমেশ্বরবাবুর বাড়ি থেকে ফোন এল।
ফেলুদা: হ্যালো, হ্যাঁ, স্যার বলুন। কী। কখন হল? আচ্ছা আমরা যাচ্ছি।
তোপসে: কী হল ফেলুদা। কোনো বাজে খবর এল নাকি।
ফেলুদা: বাজে মানে খুব বাজে খবর। সোমেশ্বরবাবুর বেয়ারা অবিনাশ খুন হয়েছে। আর সেই সঙ্গো সিন্দুক থেকে পঞ্চরত্নের কৃষ্ণ হাওয়া।
[অন্তর দৃশ্যান্তর]
[ সোমেশ্বরবাবু বাইরে বসে আছেন। পিছনে মেঝেতে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে। এমন সময় ফেলুদার প্রবেশ ]
সোমেশ্বর: আসুন, আসুন, এই দেখুন কী অবস্থা।
ফেলুদা: আপনি একে শেষবার কখন দেখেছিলেন।
সোমেশ্বর: এই দশটা নাগাদ। ঘুমোতে যাওয়ার সময়।
ফেলুদা: হ্যাঁ, আর বৃত্তের কথাটা বাইরের কে কে জানত।
সোমেশ্বর: ওই কৃষ্ণের কথা কিন্তু এ বাড়ির লোকেরা, ছাড়া কেউ জানত না।
ফেলুদা: হ্যাঁ, তাহলে এই বাড়ির ভেতর থেকেই ব্যাপারটা হয়েছে। সোমেশ্বরবাবুর ছেলে আছেন, সেক্রেটারি আছেন, আর্টিস্ট রনেন তরফদার আছেন, সূর্যকুমার কাল থেকে এখানে রয়েছেন, এর মধ্যেই কেউ গিল্টি। আর তাই যদি হয়, তাহলে তো আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে। | নেপথ্যে]
আচ্ছা সোমেশ্বরবাবু খুনটা কখন হয়েছে?
সোমেশ্বর: রাত একটা থেকে তিনটের মধ্যে।
ফেলুদা: বেয়ারা কি চোরকে বাধা দিতে গেছিল?
সোমেশ্বর: তাইতো মনে হয়।
ফেলুদা: ঘটনাটা একটু বলুন। এই বেয়ারা কি আপনার কাছে অনেকদিন কাজ করত?
সোমেশ্বর: ত্রিশ বছর। অবিনাশের মতো ভালো লোক পাওয়া খুবই দুরূহ। চোর সিন্দুক থেকে কৃত্বটা নিয়ে পালাচ্ছিল, সেই সময় হয়তো অবিনাশের ঘুম ভাঙে, সে চোরের সামনে পড়ে, তাকে ধরতে যায়। সেই সময় চোর তাকে ছুরি মেরে খুন করে।
ফেলুদা: আপনারা কে কোথায় শোন, জানতে পারি।
সোমেশ্বর: আমার ঘর তো আপনি দেখেছেন। আমি আর অনিমেষ দোতলায় শুই। বাকি সকলে একতলায় শোয়। কাল সূর্যকুমার এখানে এসেছেন ক’দিনের জন্যে, তাকে একতলায় একটা গেস্ট-কুম দিই।
তোপসে: আপনার বালিশের নীচ থেকে চাবি নিল, আর আপনি টের পেলেন না?
সোমেশ্বর: আমি যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোই। সে গভীর ঘুম।
তোপসে: সিন্দুকের চাবিটা কি রেখে গেছে।
সোমেশ্বর: হ্যাঁ, সেটা তালাতেই ভুলছে।
ফেলুদা: যে অস্ত্রটা দিয়ে খুন হয়েছিল, সেটা পাওয়া গেছে।
সোমেশ্বর: না।
[ ইন্সপেক্টর ঘোষের প্রবেশ।
ঘোষ: আরে প্রদোষবাবু যে আপনিও আছেন, তাহলে একটা কথা বলে দিই। আমি কিন্তু সকলকে জেরা করব।
ফেলুদা: আপনি জেরা করার পর আমি যদি জেরা করি তাহলে আপনার আপত্তি নেই তো?
ঘোষ: মোটেই না, আপনার কীর্তিকলাপের সঙ্গে আমি বিশেষ পরিচিত। নইলে প্রাইভেট ডিটেকটিভকে আমরা বিশেষ পাত্তা দিই না।
[ জেরা শেষ। ফেলুদা সোমেশ্বরবাবুর ছোটো ছেলে নিখিলবাবুর ঘরে এসে বসল। ]
ফেলুদা: আপনি কী করেন?
নিখিল: আমার একটা অকশন হাউস আছে মিরজা গালিব স্ট্রিটে।
ফেলুদা: নাম কী?
নিখিল: মর্ডান সেল্স ব্যুরো।
ফেলুদা: জানি, দোকানটা দেখেছি।
নিখিল: তা দেখে থাকতে পারেন। ওখানে আমি সকাল দশটা থেকে ছটা পর্যন্ত থাকি।
তোপসে: ব্যাবসা কীরকম চলে?
নিখিল: ভালোই।
ফেলুদা: আপনি আর্ট সম্বন্ধে ইন্টারেস্টেড।
নিখিল: আমার কাজের মধ্যে দিয়ে তো অনেক রকম আর্টের জিনিসপত্র আমাদের খাঁটতে হয়। সেই সূত্রে বেশকিছু জানা হয়ে গেছে।
ফেলুদা: কত বছর হল আপনি এ কাজ করছেন?
নিখিল: সাত বছর।
লালমোহন: আপনার দাদা আপনার থেকে কত বড়ো ছিলেন মশাই।
নিখিল: তিন বছর।
লালমোহন: বিদেশে গিয়ে দাদা আপনাকে চিঠি লেখেননি।
নিখিল: শুধু আমাকে না, কাউকেই লেখেননি।
তোপসে: মনে হচ্ছে দাল মে কুছ কালা হ্যায়। [ নেপথ্যে ]
লালমোহন: কেন মশাই। আপনার দাদার সঙ্গে আপনার সম্ভাব ছিল না?
নিখিল: আমার দাদা মিশুকে ছিলেন না। কথাও বেশি বলতেন না, বেশি বন্ধুবান্ধবও ছিল না। সত্যি বলতে কী, দাদার কারুর ওপরেই টান ছিল না-এমনকি আমার ওপরও না।
তোপসে: আপনার ম্যাজিক লেখার শখ হয়নি।
নিখিল: তা হয়নি, দেখতেই ভালো লাগত।
ফেলুদা: এই যে অঘটনটা ঘটল, এটার জন্য কে দায়ী সে সম্বন্ধে আপনার কোনো ধারণা আছে?
নিখিল: না। একেবারেই নেই। তবে আমি অনেকবার বাবাকে বলেছি যে কুব্লটাকে ব্যাঙ্কে রাখতে কিন্তু বাবা আমার কথায় কান দেননি।
[ নিখিলবাবুকে জেরা করা শেষ। এবার গেলেন সোমেশ্বরবাবুর বন্ধু অনিমেষবাবুর ঘরে। ]
ফেলুদা: আসতে পারি?
অনিমেষ: হ্যাঁ, আসুন। বসুন
ফেলুদা: আপনার যদি আপত্তি না থাকে এই ঘটনাটার তদন্তের জন্য আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব।
অনিমেষ: না না, আপত্তি কেন থাকবে? বলুন আপনাদের কী সাহায্য করতে পারি।
ফেলুদা: আপনি কী করেন?
অনিমেষ: আমি কিছুই করি না। আমার বাবা ছিলেন উকিল। তিনি অনেক তলার একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন, সেটার ভাড়া থেকেই আমার চলে যায়।
ফেলুদা: সোমেশ্বরবাবুর সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব কত দিনের?
অনিমেষ: তা প্রায় ত্রিশ বছর। আমি এককালে জ্যোতিষ করতাম। সোমেশ্বর আমার কাছে এসেছিল ভাগ্য গণনা। করতে। তখন থেকেই আমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব।
ফেলুদা: পঞ্চরত্নের কৃল্পটা আপনি কবে দেখেন।
অনিমেষ: ওটার কথাও আমি আমার গণনায় বলি। ওটা পাওয়া মাত্রই ও আমাকে দেখায়।
ফেলুদা: এই চুরি এবং খুন কে করতে পারে? আপনার কী মনে হয়?
অনিমেষ: বাড়ির চাকরের সঙ্গে যোগসাজশ আছে, এমন কোনো চোর বলেই বিশ্বাস। আমার ধারণা ও সিন্দুকে টাকা নিতে গেছিল, কিন্তু ঝলমলে কয়টা দেখে, সেটাই নিয়ে নেয়। বাড়ির কোনো লোক এ ব্যাপারে জড়িত বলে আমার মনে হয় না।
ফেলুদা: আচ্ছা তাহলে আজ আসি।
[ ফেলুদা ও তার সাঙ্গপাঙ্গাদের প্রস্থান ]
কাট্
।। সিন ৫ ।।
[ প্রণবেশবাবু কাজ করছেন। দরজায় টক টক আওয়াজ। ফেলুদার প্রবেশ ]
প্রণবেশ: আসুন……. বসুন।
ফেলুদা: আপনি এই বাড়িতে কত দিন ধরে আছেন?
প্রণবেশ: পাঁচ বছর।
ফেলুদা: আপনার নিজের বাড়ি কোথায়?
প্রণবেশ: ভবানীপুর, কিন্তু এ বাড়িতে এত ঘর ফাঁকা ছিল তাই আমাকে এখানে থাকার প্রস্তাব দেন।
ফেলুদা: মনিব হিসেবে সোমেশ্বরবাবু কেমন লোক?
প্রণবেশ: চমৎকার। সেদিক দিয়ে আমার কিছু বলার নেই।
ফেলুদা: কাজটা কেমন লাগে।
প্রণবেশ: সোমেশ্বরবাবু যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন, সেগুলো আশ্চর্য। টাইপ করতে করতে যে আমি কত নতুন। জিনিস জানতে পারি, তা বলতে পারব না।
ফেলুদা: আপনি কটা পর্যন্ত কাজ করেন?
প্রণবেশ: এই রাত আটটা, নটা
লালমোহন: আপনি তো একতলায় শোন।
প্রণবেশ: হ্যাঁ
লালমোহন: ঘুম কেমন হয়?
প্রণবেশ: ভালোই।
ফেলুদা: কাল কোনো কারণে রাত্রে ঘুম ভেঙেছিল বা কোনো শব্দ শুনেছেন।
প্রণবেশ: না। আমি ঘটনাটা জেনেছি সকালে উঠে।
ফেলুদা: এ বাড়ির কাউকে আপনার সন্দেহ হয়।
প্রণবেশ: সে হতে পারে। আমিও সাসপেক্টদের মধ্যে পড়ছি।
ফেলুদা: তা পড়ছেন।
প্রণবেশ: পুলিশ অবশ্য পুরো বাড়ি সার্চ করবে। কিন্তু ওইটুকু জিনিসটা লুকোতে জায়গার অভাব নেই।
ফেলুদা: তা ঠিক। এখন তাহলে আসি, দরকার পড়লে আবার আসব।
প্রণবেশ: নিশ্চয়।
[ অন্তর দৃশ্যান্তর ]
[ শংকরবাবুর ঘরে বসে ফেলুদা জেরা করছেন ]
শংকর: আপনারা এসেছেন দেখে আমি খুব নিশ্চিন্ত হলাম। আগের দিন যখন এসেছিলেন তখন আমি ছিলাম না। কিন্তু আজ দেখে ভালো লাগলো।
ফেলুদা: আপনি কখন ঘুমিয়েছিলেন।
শংকর: এই এগারোটা নাগাদ।
ফেলুদা: রাতে কোনো শব্দ পাননি।
শংকর: আজ্ঞে না, কারণ আমি কানে ঠিক শুনতে পাই না। মেশিন লাগিয়ে থাকি ভাই।
তোপসে: যে জিনিসটা চুরি হয়েছে, সেটা আপনি কোনোদিন দেখেছেন।
শংকর: কী করে দেখব। প্রথমত জানি না জিনিসটা কী। শুধু কুয় শুনেছি, এই পর্যন্ত।
[ সোমেশ্বরবাবুর ঘরে ]
ফেলুদা: আপনি কতটা যা খেয়েছেন, তা আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু যখন আমি এখানে উপস্থিত আছি তখন আপনাকে প্রশ্ন না করে পারছি না।
সোমেশ্বর: তা তো করবেনই। আপনার তো পেশাই এটা।
ফেলুদা: আপনি কোনোরকম টের পাননি, না?
সোমেশ্বর: টের পাইনি কিন্তু আঘাত পেয়েছি। প্রথমত অবিনাশের মৃত্যু, আর দ্বিতীয়ত কৃল্প চুরি। দয়াল সিং নিজে হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন “তুমিই শিল্পীর সেরা শিল্পী”। তা ছাড়া……..
ফেলুদা: তা ছাড়া……..
সোমেশ্বর: না না কিছু না।
ফেলুদা: আমার মনে হয় আসামি এই বাড়িরই কেউ। ঠিক আছে, আজ তাহলে আসি।
সোমেশ্বর: আচ্ছা। [ ফেলুদার প্রস্থান ]
আরও পড়ুন: সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায় সাহিত্য অবদান সম্পর্কিত প্রকল্প নির্মাণ
কাট্
। সিন- ৬ ।
[ মঞ্চে প্রবেশ করতে করতে ফেলুদারা কথা বলছে। ]
লালমোহন: সোমেশ্বরবাবুর কথাগুলো ভারী রহস্যজনক মনে হচ্ছিল। তাই না?
ফেলুদা: ঠিকই বলছেন।
লালমোহন: আমার মনে হয়, ভদ্রলোক বেশকিছু কথা লুকিয়ে গেলেন।
ফেলুদা: আমারও তাই মনে হয়।
লালমোহন: আপনি কী বুঝছেন।
ফেলুদা: একেবারে অন্ধকারে আছি তা নয়। তবে তার ম্যাজিকের জগৎ নিয়ে একটু অনুসন্ধান করতে হবে। অকশন-হাউসও একটা ব্যাপার। আমি বরং ঘুরেই আসি। আপনারা দুজনে আড্ডা মারুন।
তোপসে: আচ্ছা ফেলুদা, নিখিলবাবুর কথা শুনে তোমার কিছু মনে হয়েছিল।
ফেলুদা: সেটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কেন নয়, সেটা অবশ্য তোকে ভেবে বার করতে হবে।
তোপসে: হুম. বুঝলাম।
[ ফেলুদার প্রস্থান]
লালমোহন: আমার কিন্তু এই আর্টিস্ট ভদ্রলোককে মোটেই ভালো লাগছে না। অবশ্য চাপদাড়ির প্রতি আমার একটু প্রেজুডিস আছে এমনিতেই।
তোপসে: সূর্যকুমার ভদ্রলোকটিকে আপনার ভালো লাগে?
লালমোহন: ও-ও কেমন যেন পিকিউলিয়ার। তবে ও এসেই সিন্দুক খুলবে বলে মনে হয় না। ও ওই বাড়ির সঙ্গে বিশেষ পরিচিত নয়। সিন্দুকটা কোথায় আছে বা চাবিটাই বা কোথায় আছে ও বিশেষ জানবে না। আর তখন যখন অবিনাশ দেখে ফেলল, তখন ও ওকে ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে দিতে পারত। পালানো নিয়েই তো কথা, আর বেয়ারার বয়সও ঘাট-এর কম বটে।
তোপসে: আপনি ঠিকই বলেছেন।
লালমোহন: সোমেশ্বরবাবুও কী বলতে গিয়ে বললেন না, সেটা জানতে ইচ্ছে করে। মনে হয় ওখানে একটা ইম্পর্ট্যান্ট ক্লু লুকিয়ে আছে।।
[ফোন এল]
তোপসে: হ্যালো, হ্যাঁ বলুন। না ফেলুদা তো নেই, একটু বেরিয়েছেন। ও তাই নাকি, ঠিক আছে আমি ওনাকে বলে দেব।
[ দেড় ঘণ্টা পর ফেলুদার প্রবেশ ]
ফেলুদা ইন্সপেক্টরের ফোন এসেছিল। বললেন যে কালপ্রিট ধরা পরেছে।
ফেলুদা: [ অন্যমনস্কভাবে] সূর্যকুমারের ম্যাজিক ভালো হচ্ছে না, আর নিখিলবাবুর দোকানও ভালো চলছে না।
তোপসে: ফেলুদা তবে কী করণীয়?
ফেলুদা: [ ফোনে] আমি আপনার সমাধান মানতে পারছি না ইন্সপেক্টর। আমি আজ বিকেলে ঘোষণা করতে চাই সোমেশ্বরবাবুর বাড়িতে। আপনাকে উপস্থিত থাকতে হবে কালপ্রিটকে গ্রেফতার করার জন্য। থ্যাঙ্ক ইউ।
[ অন্তর দৃশ্যান্তর]
[ বিকেল পাঁচটায় সোমেশ্বরবাবুর বাড়ির নীচের বৈঠকখানায় সকলে উপস্থিত। যে-যার জায়গায় বসে আছে। ]
ফেলুদা: প্রথমেই আমাদের সামনে যে প্রশ্নটা পড়ল, সেটা হল চোর বাইরের লোক না ভেতরের লোক। এ বাড়িতে চোর যখন প্রথম আসে তার পরদিন আমরা এখানে আসি। বাড়ির চারিদিক ঘুরে আমার মনে হয়েছিল এখানে চোর ঢোকা মুশকিল। বারান্দায় থাম বেয়ে উঠলেও চুরি করে জিনিসপত্র নিয়ে নীচে নামা অসম্ভব। কাজেই আমার বাড়ির লোকের কথাই বেশি মনে হয়েছে। আর চোরের দৃষ্টি যে কীসের দিকে, সে সম্বন্ধেও আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না।
সোমেশ্বর: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে চোর এ-বাড়ির লোক।
ফেলুদা: অজ্ঞে আমি সে কথা বলিনি। আমি খালি অনুমান করেছি। আমি চুরি ও খুনের পর সকলকে জেরা করেছি। সোমেশ্বরবাবুকে জেরা করতে গিয়ে বুঝলাম যে তিনি টের পেয়েছিলেন কিন্তু বাধা দেওয়ার কোনো চেষ্টা করেননি। কিন্তু চুরির পর যে খুন হবে সেটা জানা অসম্ভব ছিল। চুরির মোটিভ একটাই হতে পারে; চোরের হঠাৎ বেশ কিছু টাকার দরকার পড়ে গেছিল।
সোমেশ্বর: আমাকে বললে তো আমিই দিয়ে দিতাম। তাই বলে চুরি করার কী হয়েছিল?
ফেলুদা: এ বাড়িতে যাঁরা থাকতেন, তাঁদের মধ্যে শংকরবাবু ছবি এঁকে রোজগার করছিলেন, সাময়িকভাবে তাঁর অবস্থা স্বাচ্ছন্দই বলা যেতে পারে। এই অবস্থায় তাঁর পক্ষে চুরি করাটা অস্বাভাবিক। অনিমেষবাবু ভালো আছেন বন্ধুর আতিথেয়তায়, কাজেই তাঁকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। এবার নিখিলবাবুর দিকে আসা যাক। নিখিলবাবুর একটা অকশন হাউস আছে। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি সে অকশন হাউসের অবস্থা খুব ভালো না। সুতরাং নিখিলবাবুর পক্ষে কৃব্লটা পাওয়া লাভজনক হবে। কারণ তিনি নিজের অবস্থা সামলে নিতে পারবেন। আমার ধারণা, প্রথম দিন নিখিলবাবু চুরি করতে ব্যর্থ হন।
নিখিল: [ রেগে গিয়ে] আপনি বিনা প্রমাণে লোককে দোষী সাব্যস্ত করছেন?
ফেলুদা: এখানে তো শেষ হয়নি-আপনি তো চুরি করতে পারেননি। কাজেই আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আসল ঘটনা হল দ্বিতীয় দিনের। প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের মধ্যে বাড়িতে একজন নতুন লোক আসেন, জাদুকর সূর্যকুমার। এটাও খোঁজ নিয়েছি যে তাঁর প্রদর্শনীতে লোকসান হচ্ছে। তাই তাঁর টাকার দরকার অবশ্যই। তাই সূর্যকুমার চুরি করতেই পারেন।
সূর্যকুমার: আপনি ভুলে যাচ্ছেন মিঃ মিত্তির, আমি এ বাড়িতে নতুন এসেছি। সুতরাং আমি এগুলোর সম্বন্ধে কিছুই জানি না।
ফেলুদা: সূর্যকুমারবাবু, আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করি এবার। সোমেশ্বরবাবুর আপনাকে খুব ভালো লেগে গিয়েছিল, তাই না।
সূর্যকুমার: তা লেগেছিল নিশ্চয়ই। তা নাহলে আর আমাকে এখানে থাকতে বলতেন?
ফেলুদা: কেন ভালো লেগেছিল।
সূর্যকুমার: তা জানি না।
ফেলুদা: আমি যদি বলি যে আপনি তাঁকে তাঁর প্রথম সন্তান অখিলবাবুর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ইন ফ্যাক্ট তিনি বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন আপনি তাঁর বড়ো ছেলে। আমি কি ভুল বলছি সোমেশ্বরবাবু।
সোমেশ্বর: কিন্তু আমার ছেলেই শেষে আমার শত্রু হল? ঠিকই বলেছেন মিঃ মিত্তির, আমি অখিলের গলার আওয়াজ চিনেছিলাম।
লালমোহন: তাহলে সূর্যকুমারও কৃষ্ণের কথাটা জানতেন?
সূর্যকুমার: আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি জানতাম। কিন্তু কৃয় সিন্দুকে ছিল না। আমি চুরি করিনি।
ফেলুদা: আপনি চুরি করেননি কিন্তু খুন করেছেন।
সোমেশ্বর: [চেঁচিয়ে ] তাহলে আমার কুরটা কোথায়?
ফেলুদা: [ ফেলুদা পকেট থেকে কুয়টা বার করে বললেন ] এই যে আপনার কৃষ্ণ। আসলে আপনাদের বাড়িতে চোর দু-বার না তিনবার এসেছিল। আমি যখন জানতে পারি সূর্যকুমার এ বাড়িতে এসেছেন, তখনই আমার সাবধানতা অবলম্বন করার ইচ্ছেটা হয়। নিখিলবাবুর সঙ্গে গলার আওয়াজ আর কথা বলার ঢং-এ মিল পেয়ে আমার প্রথমেই সন্দেহ হয় যে সূর্যকুমার আসলে অখিল বর্মন। উনি যখনই তাঁর নাম গোপন করেন তখনই আমার মনে হল যে, ওর কোনো বাজে মতলব আছে, তারপর জানতে পারি যে ওর রোজগার ভালো চলছে না-উনি দেনার দায়ে বসে আছেন, প্রতিবারই তাঁর লোকসান হচ্ছে। তখনই আমি স্থির করি যে পঞ্চরত্বের কুরুটা আর সিন্দুকে রাখা যাবে না। দারোয়ানকে মোটা টাকার ঘুস দিয়ে বাড়িতে ঢুকি। তারপর থাম বেয়ে ওপরে উঠে আমার হাত সাফাই-এর জোরে চাবি নিয়ে সিন্দুক খুলে কুরুটা সরিয়ে দিই।
লালমোহন: তার মানে আপনিই চোর আবার আপনিই গোয়েন্দা।
সোমেশ্বর: আপনার জন্য আমার কৃল্পটা বেঁচে গেল। আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব তার ভাষা আমার জানা নেই। [ সকলের প্রস্থান ]
কাট্