ভূমিকা: প্রকৃতির দেওয়া এই যে অবারিত আলোবাতাস চারিদিক থেকে আমাদের ঘিরে রয়েছে তার প্রাণস্পর্শ সম্পর্কে আমরা যেমন কখনো সচেতন নই, তেমনি একালের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা বিজ্ঞানের সংখ্যাতীত আবিষ্ক্রিয়ার উপর কতখানি নির্ভরশীল তার বিষয়েও এতটুকু সচেতন নই আমরা। দু’মুহূর্ত বসে ভাবলেই বুঝতে পারি, বিজ্ঞানকে বাদ দিলে আধুনিক সভ্যতা কতটা অসহায় হয়ে পড়ে, নিমেষে স্তব্ধ হয়ে যায় কোটি কোটি মানুষের সকল পদক্ষেপ। বিজ্ঞানের বিচিত্রদানের সঙ্গে আমাদের প্রাত্যহিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। বিজ্ঞান সাম্প্রতিককালের মানুষের জীবনকে গতিশীল করেছে। মানবমানবীর কর্মক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়েছে, কায়িক শ্রম কমিয়ে অবকাশের পরিধি বাড়িয়েছে। আগের চেয়ে আমাদের জীবনযাত্রা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও শঙ্কামুক্ত হয়েছে।
বিজ্ঞানের দান: এই সৃষ্টিশীল বিজ্ঞানের দান অপরিমেয়। যে প্রভূত সুখ সুবিধা বিজ্ঞান আজ আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে তা আগেকার মানুষের কল্পনার অতীত। দেশদেশান্তরে দূরদূরান্ত যাওয়া-আসার পথে পরিবহন ব্যবস্থা তো ছিলই না, তাছাড়া পথ ছিল দুর্গম, বিপদসঙ্কুল। বর্তমানে দূরত্ব বিজ্ঞানের কাছে হার মেনেছে-দূর হয়েছে নিকট।
আমরা অন্ধকারকে জয় করেছি বিদ্যুৎকে হাতিয়ার করে। সুইচ টিপলেই অন্ধকার ভেদ করে চারিদিকে আলোর রোশনাই-এ ভেসে ওঠে। হিটার, মাইক্রোওয়েভ, কুকার, মিক্সার-গ্রাইন্ডার আবিষ্কৃত হওয়াতে রান্নার কাজেও যথেষ্ট সুবিধা হয়েছে। ওয়াশিং মেশিন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, অ্যাকুয়াগার্ড, ফ্রিজ, টিভি ইত্যাদি আবিষ্কৃত হবার ফলে বর্তমানের জীবনযাত্রা অনেক সুগম হয়েছে। ইলেকট্রিক পাখা, গীজার, এয়ার কন্ডিশনার আমাদের জীবনকে আরো মধুময় করেছে। এছাড়া কম্পিউটার, স্মার্টফোনের দৌলতে আমাদের যেকোন অফিসিয়াল কাজ যেমন ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যাঙ্কের লেনদেন, রেল-বিমানের টিকিট কাটা, ডাক্তার-হসপিটাল-নার্সিহোমের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ, যেকোনো বার্তা, ছবি, ব্যক্তিগত কোন তথ্য পাঠানো, গান, নাচ, সিনেমা যেকোন ধরণের তথ্যই আমরা পাচ্ছি কম্পিউটারে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এমনকি স্কুল কলেজে ভর্তি, টাকা জমা দেওয়া, হোটেল বুকিং, ট্যাক্সি বুকিং সবই এখন হাতের মুঠোয় স্মার্ট ফোনের দৌলতে।
চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগ: বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে নানা মারণব্যাধির ওষুধ। যারা কানে শুনতে পান না তাদের জন্য তৈরী হয়েছে শ্রবণযন্ত্র। মানুষকে রোগমুক্ত করার জন্য, জীবাণু ধ্বংস করার জন্য নানা ধরনের রশ্মি আবিষ্কৃত হয়েছে। -যার ফলস্বরূপ মানুষের আয়ু আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে, বিজ্ঞান দৃষ্টিহারাকে দৃষ্টিদান করছে। এমনকি হার্টের বদলে পেসমেকার বসিয়ে মানুষকে বাঁচিয়েছে। এমনকি বিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে একজন মানুষের লিভার, কিডনি ইত্যাদি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
বর্তমানে Nutrition বা পুষ্টিবিজ্ঞান নামে বিজ্ঞানের আরেক শাখার সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে খাদ্যের গুণাগুণ নিরূপিত হয়। খাদ্যে ক্যালরির সঠিক পরিমাণ, কোন কোন খাদ্যে কতটা কী জাতের ভিটামিন রয়েছে, তা এর সাহায্যে জানা যায়। পুষ্টিকর খাদ্য অল্প পরিমাণে খেলে স্বাস্থ্যের উন্নতি বিধান হয়।
কৃষিবিজ্ঞানে বিজ্ঞনের প্রয়োগ: কৃষিবিজ্ঞান বিজ্ঞানের অপর এক শাখা যেখানে নিত্য নতুন গবেষণার ফলে আমাদের দৈনন্দিন খাবারগুলির মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং কৃষিক্ষেত্রে যেসব যন্ত্রপাতি লাগে, তা আরো উন্নততর হচ্ছে। এছাড়া কৃষির ফলন যাতে আরো ভালো হয় তারও চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি পশু প্রজননের ক্ষেত্রেও আমরা সাহায্য নিচ্ছি বিজ্ঞানের। যদিও প্রকৃতিলোকের রহস্যের চাবিকাঠি আমাদের কাছে নেই, তবুও বিজ্ঞানীরা নানা ধরণের মহাকাশযান, রকেট ইত্যাদি উৎক্ষেপণ করে পাড়ি দিচ্ছেন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। নানা ধরণের স্যাটেলাইট আবিষ্কারের ফলে কোথায় কখন ভৌগোলিক পরিবেশ পরিস্থিতি কেমন থাকবে তা আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মৎসজীবীরা বিরূপ আবহাওয়া আগে থেকে জানতে পারার জন্য প্রাণহানির শঙ্কা আগের চেয়ে খানিকটা কমেছে।
উপসংহার: আমাদের ত্রুটিপূর্ণ সমাজে বিজ্ঞানের দান সমাজের অল্পসংখ্যক মানুষের ব্যক্তিগত সুখবিলাসের সামগ্রী হয়ে রয়েছে। এ দান যেদিন সর্বস্তরে গিয়ে পৌঁছবে সেদিনই বিজ্ঞানীর সাধনালব্ধ সম্পদটি সার্থক হয়ে উঠবে। সর্বস্থানিক ও সর্বকালিক মানুষের সেই অর্থনীতিক মুক্তির অপেক্ষায় আমরা আছি। সাম্যতন্ত্রী সমাজে বিজ্ঞান সর্বমানবের সেবায় নিযুক্ত হোক-এই কামনা করি।