উচ্চমাধ্যমিক (ক্লাস ১২) এর শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য আজকের পোস্টে সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায় সাহিত্য অবদান সম্পর্কিত প্রকল্প তোমাদের সাথে শেয়ার করা হল। যেটি তোমাদের প্রজেক্ট ওয়ার্ক তৈরি করতে সহায়তা করবে।
সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায় সাহিত্য অবদান
সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের এক সন্ধিক্ষণের সৃষ্টি। এমন এক সন্ধিক্ষণ যখন বুদ্ধি আর আবেগ, মস্তিষ্ক এবং হৃদয়, বাস্তবতা ও অবাস্তবতা একটা স্বচ্ছ পরিণামী সমানুপাতে অবস্থান করতে চাইছিল। অপেক্ষায় ছিল এমন একজন শিল্পীর যিনি সাহিত্যের এই অবস্থানটি নির্দিষ্ট করবেন এবং তাকে সাহিত্যে রূপ দেবেন।
সত্যজিৎ রায়ের জন্ম উত্তর কলকাতার ১০০নং গড়পাড় রোডে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২ মে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পৌত্র এবং সুসাহিত্যিক সুকুমার রায়ের পুত্র সত্যজিতের তখন নাম রাখা হয় প্রসাদ। পরের বছর নাম পরিবর্তন করে সত্যজিৎ রাখা হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে ভরতি হন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে প্রবেশ করেন। এরই সঙ্গে সংগীত ও চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখা দেয়। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে যান এবং কলাভবনে ভরতি হন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনের কলাভবনের পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় ফিরে আসেন। এরপর ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঝিন্দের বন্দি, বিলাসন, কালিন্দী, ফসিল প্রভৃতি চিত্রনাট্য রচনা করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা করেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রণ প্রদর্শনীতে ‘যাই যাই’ আর ‘অনন্যা’ গ্রন্থের প্রচ্ছদের জন্য পুরস্কার পান।
একের পর এক বিখ্যাত চিত্রপরিচালনার পাশাপাশি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুগ্ম-সম্পাদনায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পুনঃপ্রকাশ আরম্ভ করেন। বাংলা সাহিত্য রচনায় হাত দেন। লিয়রের ছড়া অবলম্বনে তাঁর প্রথম লেখা ‘পাপাঙ্গুল’। ‘ফেলুদা’ সিরিজের গল্প প্রকাশিত হয় ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ‘প্রফেসর শঙ্কু’ গ্রন্থটি আকাদেমি পুরস্কার অর্জন করে। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম ফেলুদা গ্রন্থ ‘বাদশাহী আংটি’ প্রকাশিত হয়। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে সত্যজিৎকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘ডক্টর অফ লেটারস’ এবং ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ আর্টস কর্তৃক ‘ডক্টরেট’ উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করা হয় তাঁকে। ১৯৭৮-এ ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘ডিলিট’ প্রদান করা হয়।
সাহিত্যের নতুন পটভূমির অবস্থান সত্যজিতের হাতে। তাঁর সাহিত্যকে শিশুসাহিত্য বলা হবে; না কিশোর সাহিত্য, না বড়োদের জন্য রচিত সাহিত্য-এ একটা চরম প্রশ্ন। উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমারের যোগ্য উত্ত রাধিকারী তিনি। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্য যে অর্থে শিশুসাহিত্য, সুকুমারের সাহিত্য সে অর্থে সার্স ১৪ শিশুসাহিত্য নয়। সত্যজিতের সাহিত্যের পরিমন্ডলে বৃদ্ধির ও
মস্তিষ্কের উপাদানগুলি এমন সীমায় এসে পৌঁছোল যে, আবেগ ও উদ্ভট রসের সঙ্গে ‘পয়েজড’ (poised) অবস্থায় অবস্থান করতে শুরু করল। সেজন্য ঐতিহ্যগতভাবে যাকে আমরা শিশুদের জগৎ বলে জানি সত্যজিতের জগৎ সেটা নয়। সত্যজিতের জগৎ শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ সকলেরই আনন্দসম্মত চারণভূমি। সত্যজিৎ এটা করেছেন একেবারে সচেতনভাবে, বংশগত বিজ্ঞানমনস্কতার আশ্রয় নিয়ে। সত্যজিতের বিজ্ঞানবোধ ও বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা তাঁকে বাধ্য করেছিল বুদ্ধির জগতে আশ্রয় নিতে। এজন্য হয়তো তাঁর সাহিত্যে বাস্তবতা এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছোতে পারত যাতে তাঁর সাহিত্য কখনোই কিশোরদের বা ছোটোদের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকত না। সত্যজিতের সাহিত্য বাস্তব ও অবাস্তবতার এমন এক গণ্ডিতে তথা এমন এক পরিধিতে অবস্থান করে যেখানে অবাস্তব ও উদ্ভট রসকেও অবাস্তব বা উদ্ভট বলে মনে। হয় না। কখন যে পাঠক জানা ডায়েমেনশনগুলিকে অতিক্রম করে চতুর্থ মাত্রায় প্রবেশ করেন আবার কখন যে বের হয়ে আসেন তিনি নিজেই। বুঝতে পারেন না। এরকম একটা অনাবিল আনন্দজগতের স্রষ্টা সত্যজিৎ।
তাঁর সাহিত্যকে মূলত চারভাগে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। এক- গোয়েন্দাকাহিনি, দুই কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক শঙ্কুকাহিনি, তিন- গল্প, চার- অনুবাদ। এই চারটি ভাগের মধ্যে কতকগুলি সাধারণ ধর্ম। অবশ্যই বর্তমান। তার প্রথম এবং প্রধান হল ভাষা। এমন তরতরে ঝরঝরে ভাষায় রচিত সত্যজিতের সাহিত্য যে তার প্রবাহচ্ছলতাই আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাঁর ভাষাতেই, তাঁর যে-কোনো বই, তা সে গল্পের বই হোক, গোয়েন্দাকাহিনিই হোক বা কল্পবিজ্ঞানের গল্পই হোক- একেবারে ‘unputdownable’। যেন কোনো জগদ্বিখ্যাত গল্পকথক হঠাৎ এসে গল্প বলতে শুরু করেছেন এমন ভাষায় যা আপামর জনসাধারণ সবাই বুঝবে। একেবারে অলঙ্কারবিহীন ভাষা। তৎসম শব্দসমন্বিত জটিল বাক্য গঠন নেই, নেই এমন কোনো উক্তি যা বুঝতে গেলে বাকাটি কয়েকবার পড়তে হবে। বহু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন তিনি, আবার বহু শব্দ সৃষ্টি করেছেন; তবে তা আমাদের কথ্যভাষাই যেন। গোয়েন্দাকাহিনিগুলিতে অনেক জটিল প্লট সৃষ্টি করে প্লটের উন্মোচন করেছেন। গোয়েন্দাকাহিনিতে হোক বা শঙ্কু কাহিনিতেই হোক প্রচুর ইতিহাসের তথ্য, ভূগোলের তথ্য, বিজ্ঞানের তথ্য সন্নিবেশিত করেছেন। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে, তিনি উক্ত বিষয়গুলি সম্বন্ধে কিশোরদের বা যুবকদের অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তোলার জন্যই হয়তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই তাঁর লেখাকে তথ্য ভারাক্রান্ত করেছেন। অথচ লেখা কখনোই ভারবহুল বলে মনে হচ্ছে না। এই অসাধ্য সাধনের জন্য তিনি ঘটনার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। গোয়েন্দা গল্পের, শঙ্কুকাহিনির, এমনকি গল্পের ঘটনাগুলি এমনই চিত্তাকর্ষক যে পাঠক বুঝতেই পারবেন না তিনি বহু ঐতিহাসিক তথ্য ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছেন।
ফেলুদা: বাংলার গোয়েন্দাকাহিনির ক্ষেত্রে আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস বহুদিন ধরেই স্বীকৃত মডেল হিসেবে কাজ করেছে। এদিক থেকে শ্রেষ্ঠ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাও নিঃসন্দেহে শার্লকি ঢঙের। তবে ব্যোমকেশের সঙ্গে ফেলুদার ফারাক গল্পের বিষয়ে এবং পরিবেশনায়। ব্যোমকেশের – অপরাধ জগতের মধ্যে নারী-পুরুষের সম্পর্কের বিভিন্ন অন্ধকার দিক মাঝেমাঝেই এসে পড়ে। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরিতে অপরাধ জগতের পাশাপাশি যে ভ্রমণের আমেজ পাওয়া যায় এবং যেভাবে হঠাৎই ইতিহাসের ছোঁয়া এসে লাগে তা বাংলা গোয়েন্দাগল্পের ক্ষেত্রে এক বিরল সংযোজন। আমাদের মনে পড়বে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু-সন্তুকে। সেখানেও কণিষ্ক, আন্দামানে পলাতক স্বাধীনতা সংগ্রামী, প্রথম ছাপা বাইবেল প্রভৃতি প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে কাকাবাবু-সন্তু ঠিক গোয়েন্দাকাহিনি নয়, বরং অ্যাডভেঞ্চার। গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে ফেলুদাকে যে কখনও বিপদে পড়তে হয়নি তা নয়, কিন্তু তা কখনোই কাকাবাবু-সন্তুর মতো নয়। ফেলুদা থাকেন কলকাতায় এবং ফেলুদার ছবি দেখে ও সিনেমা
দেখে বোঝা যায় সাতাশ থেকে মধ্য তিরিশের মধ্যবর্তী এই চরিত্রটি সব অর্থেই নাগরিক বুদ্ধিজীবী। ফেলুদা একজন বড়ো পাঠক, তার উৎসাহ প্রায় প্রতিটি বিষয়েই। কিন্তু কখনোই তাকে গ্রন্থকীট বলা যায় না। ফেলুদার পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা অসাধারণ। শার্লক হোমস যেমন প্রয়োজনে সাহায্য নিতেন তাঁর দাদার, তেমনি ফেলুদার আছে সিধুজ্যাঠা। সিধুজ্যাঠাও কলকাতার টিপিক্যাল বিলাসী বুদ্ধিজীবী। ফেলুদার দুই সাগরেদ তোপসে এবং জটায়ু গল্পে দুরকম ভূমিকা পালন করেছে। তোপসে ফেলুদার খুড়তুতো ভাই। বয়সে কিশোর। যার জবানীতেই ফেলুদার গল্পগুলো তৈরি। খুব স্বাভাবিকভাবেই যে-কোনো শিশু ও কিশোর খুব সহজেই নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারে তোপসের সঙ্গে এবং ফেলুদাও সহজেই হয়ে ওঠে পাঠকেরও দাদা।
জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলির সঙ্গে ফেলুদার আলাপ রাজস্থান যাওয়ার পথে ‘সোনার কেল্লা’ গল্পে। সিনেমায় অন্যরকমভাবে দেখানো হলেও গল্পে লালমোহন গাঙ্গুলি ছিলেন সন্দেহভাজনদের মধ্যে একজন। কিন্তু ‘সোনার কেল্লা’র পর প্রায় সবকটা কাহিনিতেই জটায়ু উপস্থিত। জটায়ু রহস্যরোমাঞ্চ গল্পের লেখক। কিন্তু তাঁকে দেখতে, তাঁর হাবভাব একেবারে উলটো চরিত্রের। সরল সাদাসিধে এক বাঙালি। তিনি নামের কাঙাল, আড্ডাবাজ এবং ভীতু। কিন্তু সময়ে সময়ে তাঁর মতো সাহসী লোক পাওয়া ভার। গল্পের মধ্যে মজার চরিত্র হিসেবে লালমোহনের উপস্থিতি। ফেলুদা আর তোপসের সঙ্গে বয়সে বড়ো লালমোহন বন্দুর মতোই মিশে যান। আর এভাবে মিশে যান বলেই ফেলুদা আর তোপসের পিছনে লাগা থেকে শুরু করে নানান মজাদার ঘটনা তিনি ঘটিয়ে চলেন। এ কথা স্বীকার না করে কোনো উপায় নেই যে, লালমোহন গাঙ্গুলি ছাড়া ফেলুদার গল্প এত আনন্দদায়ক এবং রসাল হত না।
শত্রু: প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু প্রিয়জনের কাছে তিলু নামে পরিচিত। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুন গিরিডিতে তাঁর জন্ম। পিতার নাম ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু। তিনি ছিলেন গিরিডির অপ্রতিদ্বন্দ্বী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহ বটুকেশ্বর তন্ত্রসাধক। গিরিডির স্কুল থেকে শঙ্কু বারো বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাস করেন। কলকাতার কলেজ থেকে মাত্র যোলো বছর বয়সে ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডবল অনার্স নিয়ে বিএসসি পাস করেন। বিশ বছর বয়সে কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এ সময়েই ইংরেজ জীবতত্ত্ববিদ (স্বর্ণপণী) মতান্তরে ভূতত্ত্ববিদ জেরেমি সন্ডার্স-এর সঙ্গেঙ্গ পত্রালাপ শুরু। পরে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয়। মাত্র চার বছর অধ্যাপনার শেষে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। পরিণামে শঙ্কু অধ্যাপনা ত্যাগ করে পূর্ণ সময়ের জন্য গিরিডিতে গবেষণা শুরু করেন। তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র, ওষুধ ইত্যাদির সংখ্যা মোটামুটি ৩৯। শঙ্কু ব্ল্যাক কফি খেতে আর উশ্রীর ধারে বেড়াতে পছন্দ করেন। তাঁর সঙ্গীরা হলেন পুরোনো চাকর প্রহ্লাদ, বিড়াল নিউটন, প্রতিবেশী অবিনাশবাবু, বৈজ্ঞানিক কোল ও সন্ডার্স। অস্ট্রেলিয়া ও উত্তর আমেরিকা বাদে বাকি মহাদেশে মোট অভিযানের সংখ্যা- ৩৭। তাঁর সবকটি অভিযানের কাহিনি ডায়ারি হিসেবে লেখা। কোথাও সালের উল্লেখ নেই, তারিখ আছে; কোথাও কোথাও বার এবং কোথাও সময়ের উল্লেখ আছে।
প্রথম গল্প ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেটি পাওয়া গিয়েছিল সুন্দরবনের মাথারিয়া অঞ্চলে এসে পড়া এক উল্কাপতনের ফলে সৃষ্ট গর্তের ঠিক মধ্যিখানে। এটি এক বিশেষ কাগজে বিশেষ কালিতে লেখা। কাগজটি কুকুরে কামড়ে ছিঁড়তে পারে না, আগুনে পোড়ানো যায় না, টানলে রবারের মতো বড়ো হয় আর ছাড়লে যা ছিল তাই থাকে। কালির রং ঘন্টায় ঘন্টায় বদলায়। তার লেখাটা কপি হয়ে গেলে ডেয়ো পিঁপড়ে সবটা উদরসাৎ করে ফেলে। বাকি গল্পগুলি তার গিরিডির বাড়িতে পাওয়া একুশটি ডায়ারি থেকে নেওয়া। শঙ্কুর গল্পগুলির মাধ্যমে আমরা রচয়িতা সত্যজিতের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, ভৌগোলিক জ্ঞানের পরিচয় পাই। এ ছাড়াও রসিক সত্যজিতের রসিকতারও পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর তৈরি গবেষক বৈজ্ঞানিক শঙ্কু এক বিশিষ্ট মানবতাবাদী। যেখানে অন্যায়, যেখানে মানবসভ্যতা সংকটের সম্মুখীন; সেখানেই শঙ্কুর ডাক পড়ে। ক্যানসারের ওষুধের আবিষ্কারক ড. টমাস গিলেটকে বাঁচাতে শঙ্কুর ডাক পড়ে। আবার তারই কৃতিত্বে ইহুদিবিদ্বেষী হান্স রেডেল ইহুদিবিদ্বেষ ত্যাগ করে নতুন মানুষ হয়ে ওঠে। শঙ্কুর কাছে মানুষের চেয়ে উন্নততর প্রাণী থাকা সত্ত্বেও শঙ্কুর মতে- “এরা যদি সত্যিই মানুষ না হয়, তাহলে এরা যতই উন্নত প্রাণী হোক না কেন, সুখ-দুঃখ সকাল-সন্ধ্যা চন্দ্র সূর্য, ফুল ফল রং রস খেলাধূলা পশুপাখি নিয়ে মানুষই ভাল।”
শঙ্কু ও ফেলুদার গল্প ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একাধিক গল্প লিখেছেন সত্যজিৎ। তাঁর গল্পগুলি কাহিনিকার সত্যজিতের অনন্য- সাধারণ সৃষ্টি। প্রতিটি গল্পই প্রায় মুক্তোর মতো। ভূতেদের প্রতি তো তাঁর পক্ষপাত ছিলই। উপস্থাপনাও চমৎকার। বাস্তবসম্মত তথ্যগত বর্ণনা দিয়েও পরিমণ্ডলটিকে কী করে ভৌতিক করে তোলা যায় তা আমরা সত্যজিতের লেখা থেকেই জানতে পারি। যে চরিত্রটি ভৌতিক অস্তিত্ব অনুভব করছে হয়তো সেই চরিত্রের চেহারাটাই মৃত ব্যক্তিটির মতো হয়ে যায় হঠাৎ। সে হয়তো ডাকবাংলোর মৃত সাহেবটির আকৃতি আয়নায় নিজের চেহারায় প্রতিফলিত হতে দেখে ভয়ানক ভীত হয়ে উঠে চৌকিদারকে ডাকে, কিন্তু কণ্ঠস্বর থেকেও নির্গত হয় সাহেবি ঢঙের উচ্চারণ- ‘ছা-উ-বি-ভার’। যে ব্যক্তি ভৌতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করছে তার মানসিকতাটি কিন্তু ঠিক থাকে। চরিত্রটি নিজে বুঝতে পারছে যে সে ভূতের খপ্পরে পড়েছে এবং আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পাঠককে দুলিয়ে রাখার ক্ষমতা সত্যজিতের ছিল অসাধারণ। ‘অনাথবাবুর ভয়’, ‘বাদুড় বিভীষিকা’, ‘নীল আতঙ্ক’ ইত্যাদি তাঁর লেখা রোমাঞ্চকর ভূতের গল্প।
শুধু ভৌতিক গল্প নয়, ‘সেপ্টোপাসের খিদে’ থেকে শুরু করে তাঁর প্রতিটি গল্পই উল্লেখযোগ্য। ‘বন্ধুবাবুর বন্ধু’ গল্পে নিরীহ স্কুলমাস্টার বন্ধুবাবুর জীবনে ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং আবির্ভূত হয়ে তাঁর আত্মপ্রত্যয় ফিরিয়ে আনে। তিনি প্রতিবাদ করার ক্ষমতাও অর্জন করেন। এই ক্ষমতার প্রকাশটিও ছোটোদের গল্পসুলভ। এমনকি প্রতারণার গল্পও কীভাবে মানবিক গুণে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে তাও সত্যজিতের গল্পে লক্ষ করা যায়। ‘টেরোডাকটিলের ডিম’, ‘বিপিন চৌধুরির স্মৃতিভ্রম’ ইত্যাদি গল্পের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ‘টেরোডাকটিলের ডিম’ গল্পে ছাপোষা, নিম্নবিত্ত অথচ কল্পনাপ্রবণ মানুষ, যাঁর হৃদয় প্লাবিত করে আছে ভালোবাসা ও সহজ বিশ্বাস, তিনি অর্থাৎ বদনবাবু। যখন অফিসে মাইনে পাওয়ার দিনই প্রতারিত হন এবং যখন তাঁর মাইনের অংশবিশেষ খোয়া যায় তখন বদনবাবুর মতোই আমরা চিন্তিত হয়ে উঠি ঠিকই, কিন্তু প্রতারকের ওপর ক্রোধ হয় না। গল্পের বিন্যাসে এমন কিছু থাকে যাতে গরীব বদনবাবুর মতো আমাদেরও বলতে ইচ্ছে করে- ‘বিল্টুর খুশির খোরাক আজ একদিনে অত পেয়েছেন তিনি তার দাম
কি অন্তত পঞ্চান্ন টাকা বত্রিশ নয়া পয়সাও হবে না?’
‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ নামক গল্পটিও চমৎকার। জীবনে হেরে যাওয়া অতি দরিদ্র একজন মানুষ পটলবাবু। ফিল্মের একটি দৃশ্যে জীবনে একবার মাত্র পাওয়া সুযোগে শুধু ‘আঃ’ শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়ে তাঁর সুপ্ত শিল্পীসত্তার যে পরিচয় দেন এবং টাকা না নিয়েই সকলের অজ্ঞাতসারে আত্মতৃপ্তিতে ভরপুর পটলবাবু যখন স্থানত্যাগ করেন, তখন পাঠকের অন্তরে যে বেদনাঘন বিষাদময় আনন্দানুভূতি সঞ্চারিত হয় তা কি কখনও ভুলে যাওয়ার। সত্যজিতের অনেক গল্পে বুড়োদের মধ্যে লুক্কায়িত খোকাটি কখন যে বের হয়ে এসে জীবনের মানিগুলিকে সবলে দূরে ঠেলে দেয়, তা অনেক সময় বোঝাই যায় না। ‘ক্লাসফ্রেন্ড’, ‘পিন্টুর দাদু’ ইত্যাদি গল্পগুলি এদিক থেকে উল্লেখযোগ্য। ‘অতিথি’ নামক গল্পটি (যেটি একটু পরিবর্তিত আকারে তাঁর শেষ সিনেমাচিত্র ‘আগন্তুক’) এক অত্যন্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থঘরের কাহিনী, কিন্তু শান্ত-সুন্দর-সংযত মানবতায় আপ্লুত।
অনুবাদ: এবার আসা যাক সত্যজিতের অনুদিত কবিতা ও গল্পে। তাঁর লিয়রের ছড়ার ও লুই ক্যারলের কবিতার (ননসেন্স ভার্সের) অনুবাদ তুলনারহিত। বিশেষ করে ‘পাপাঙ্গুল’ কোনোদিন ভোলা যাবে না, ভোলা যাবে না ‘ডং’ বা ‘মেছোগান’। তাঁর অনুবাদ অত্যন্ত মূলানুগ অথচ প্রায় মৌলিক বলে মনে হয়। ক্যারলের অর্থহীন শব্দগুলির ধ্বনিকে পর্যন্ত সত্যজিৎ বাংলা কবিতার অর্থহীন শব্দসমষ্টির মধ্যে ধরে রেখেছেন, নামকরণে তো বটেই লাইনগুলিতে পর্যন্ত; অথচ ‘জবরখাকি’ কবিতাটি কেমন যেন একটা অর্থ পেয়ে যাচ্ছে। ‘রিদে এন্ড দ্য স্লিথি টোবস্’ তাঁর অনুবাদে ‘বিল্লিগি আর মিথলে যত টোবে’ নামক অর্থহীন শব্দসমষ্টিতে পরিণত হয়। ক্যারলের তথা সত্যজিতের এই ম্যাজিক কী করে নিলেন সাং অংশীন ধ্বনিসমষ্টি দিয়ে অর্থময় ব্যঞ্জনা কীভাবে তৈরি হয়? ‘জবরখাকি’র’ প্রথম ছাড় লাইন
“বিল্লিগি আর মিনথলে যত টোবে
গালুমগিরি করছে ভেউয়ের পরে
মিম্সে মেরে যাচ্ছে বোরোগোবে
মোমতারা সব গড়বড়িয়ে মরে।”
উদ্ধৃতাংশটিতে অধিকাংশ শব্দই অর্থহীন। কিন্তু সত্যজিৎ ক্যারলের মতোই মাঝে মাঝে কিছু অর্থযুক্ত শব্দ ঢুকিয়ে সমগ্র কবিতাটি থেকে একটি ছবি ফুটিয়ে তুলতে চাইছেন। ওই অর্থযুক্ত শব্দগুলি, ম্যাজিকের মতো অর্থহীন ধ্বনিসমষ্টি থেকে, কুয়াশার আড়াল থেকে ভেসে আসা মূর্তির মতো ছবির সৃষ্টি করতে চাইছে। উল্লিখিত কবিতাটি সেরা সন্দেশে এবং তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিমে দুরকমভাবে ছাপা হয়েছে। শব্দের প্রভেদ বিস্তর। শুধু লিয়র বা ক্যারল নয়। অন্যান্য আরও দু-একজন বিদেশি কবির ছোটোদের কবিতারও এরকম চমৎকার অনুবাদ করেছেন তিনি। ‘ব্রেজিলের কালোবাঘ’ নামক অনুবাদ গ্রন্থটিও উল্লেখযোগ্য। নাম এ গল্পটি ছাড়াও তিনি এই বইটিতে কোনান ডয়েলের আরও দুটি গল্পের ৪ অনুবাদ করেছেন। তিনটি গল্পই গোয়েন্দাকাহিনি না হলেও রহস্যগল্প প বা হরর স্টোরি। এই ধরনের অনুবাদকর্ম দুঃসাধ্য হলেও সত্যজিৎ এই অনুবাদকর্মে আশ্চর্যজনক ভাবে সফল হয়েছেন। চরিত্রগুলির বা স্থানগুলির নাম বদলে দিলে একেবারে মৌলিক বলে মনে হবে অনুবাদগুলিকে। বইটিতে আর্থার মি ক্লার্কের ও রে ব্র্যাডবেরির একটি করে গল্পের অনুবাদও আছে।