মুন্সী প্রেমচাঁদ ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই বারাণসীর কাছে এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ধনপত রাই শ্রীবাস্তব। ছোটোবেলায় মা মারা যাওয়ার পর নিঃসঙ্গ জীবনে গল্পের বই-ই ছিল তাঁর একমাত্র সঙ্গী। দশম শ্রেণি উত্তীর্ণ হওয়ার পরে প্রেমচাঁদের শিক্ষাজীবন আর দীমায়িত হয়নি। প্রেমচাঁদ তাঁর লেখায় মানুষের শোষণ-বঞ্ছনা, জীবন সংগ্রামের অনবদ্য রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। প্রায় এক ডজন উপন্যাস আর আড়াইশোর মতো ছোটোগল্প প্রেমচাঁদের সাহিত্য প্রতিভার নিদর্শন হয়ে আছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল দেবস্থান রহস্য, করদান, রণভূমি, গোদান ইত্যাদি এবং ছোটোগল্প। সংকলন হল দুনিয়া কা সব সে আনমোল রতন, উপদেশ, পরীক্ষা ইত্যাদি। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ অক্টোবর তিনি প্রয়াত হন। এখানে তাঁর ‘বিষম সমস্যা’ গল্পটি ‘ভীষণ সমস্যা’ নামে বাংলায় অনূদিত হল।
ভীষণ সমস্যা সটীক অনুবাদ প্রজেক্ট
মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেসব শুনতে থাকে। যেন সে কোনো খুনের আসামি। এমন একটা মামুলি বিষয়ে বড়োবাবুর এই ভয়ংকর মেজাজ দেখে আমার খুবই খারাপ লাগল। যদি অন্য কোনো পিয়ন এর থেকেও গুরুতর অপরাধ করত তাকে এরকম কঠোর তিরষ্কারের মুখোমুখি হতে হত না। আমি ইংরেজিতে তাঁকে বললাম- “স্যার, আপনি এটা ঠিক করছেন না। ও ইচ্ছে করে কালি ফেলেনি। ওকে এভাবে কঠোর শাস্তি দেওয়া অত্যন্ত অনুচিত।’
বড়োবাবু সহজভাবে বললেন, “আপনি ওকে জানেন না। ও একটা শয়তান।”
“আমি তো ওর মধ্যে খারাপ কিছু দেখিনি।’
“মশায়, আপনি এসব ব্যাপার বুঝবেন না। আর কিছুদিন এখানে থাকুন, আপনি বুঝতে পারবেন ও কী ধরনের বদমাশ
আর-একজন ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “স্যার, ওর বাড়িতে কয়েক মণ দুধ
এবং দই তৈরি হয়, কয়েক মণ মটরশুটি, যব এবং নানা উৎপাদন হয়। কিন্তু ও কোনোদিনও অফিসের লোকদের কিছু দেবার কথা ডাবেগুনি। এসব জিনিস আমাদেরও পেতে ইচ্ছা হয়। তাই আমরা কেন রেগে যাব না? ও এখানে চাকরি পাওয়ার পরেই এসব করেছে। আগে ওর একটা দানাও ছিল না।”
বড়োবাবুকে একটু বিব্রত দেখাচ্ছিল। তিনি বললেন, “এটা কোনো আলোচনার বিষয় নয়। এসব ওর নিজের, এটা ওর বিষয়, ও সেটা কাউকে দেবে কি না। কিন্তু সত্যি বলতে ও একটা জন্তু।’
আমি বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করলাম, বললাম, “যদি সে সত্যিই এরকম নীচ মনের মানুষ হয় তাহলে সে প্রকৃতই একটা জন্তু। আমি এসব জানতাম না।’
এবার বড়োবাবু মুখ খুললেন। তিনি বললেন, “এরকম নয় যে উপহার পেলেই কেউ বড়োলোক হয়ে যাবে, এটা উপহার দাতার মহত্বকেই প্রমাণ করে। তা ছাড়া বিত্তশালীর কাছে সবারই প্রত্যাশা থাকে। যে অসমর্থ তার কাছে কেউই কিছু প্রত্যাশা করে না। একজন উলল বাত্তির থেকে কীই-বা নেওয়ার আছে?”
রহস্যটা বোঝা গেল। বড়োবাবু গোটা পরিস্থিতিটা সহজ কথায় বুঝিয়ে দিলেন। অন্যের সমৃদ্ধি সকলেরই ঈর্ষার কারণ, ছোটো-বড়ো ধনী-গরিব নির্বিশেষে। আমাদের শ্বশুরবাড়ি বা আত্মীয়স্বজন দরিদ্র হলে আমরা তাদের থেকে বিশেষ কিছু আশা করি না। সত্যি বলতে কী, আমরা তাদের ভুলেও যাই। কিন্তু যার সামর্থ্য আছে সে যদি আমাদের খোঁজ না নেয়, পালা-পার্বণে আমাদের উপহার না পাঠায় তখন আমাদের মনে ঈখা জাগে। কোনো গরিব বন্ধুর বাড়ি গেলে, একটা পান মুখে দিয়েই আমরা সন্তুষ্ট হই। কিন্তু একজন ধনী বন্ধুর বাড়ি থেকে অভুক্ত অবস্থায় এলে সবাই তার সমালোচনা করি ও সর্বদা তার নিন্দা করি। যদি সুদামা কৃষ্ণের বাড়ি থেকে অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে আসত, তাহলে শিশুপাল বা জরাসন্ধের থেকেও সে হত কৃষ্ণের সবচেয়ে বড়ো পদ্ম। এটাই মানব প্রকৃতি।
কয়েকদিন পরে আমি গরিবকে জিজ্ঞাসা করলাম, “হ্যাগো ডাই, তুমি কি দেশে চাষ-আবাদ করো?”
গরিব খুব সরল কন্ঠস্বরে বলল, “হ্যাঁ হুজুর, তা আমার আছে। আমার দুজন ভৃত্য আছে। তারাই সব করে।”
“তোমার গোরু-মহিষও আছে?”
“হ্যাঁ চুজুর, দুটো মহিষ আছে। গোরুগুলির পেটে এখনও বাচ্চা আসেনি। চুজুর মানুষের দয়াতেই আমাদের পেট চলে যাচ্ছে।’
“তুমি কখনও অফিসের কেরানিবাবুদের খাতির করে কিছু দিয়েছ?”
গরিব অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, “হুজুর, আমি কীভাবে বাবুদের খুশি করার জিনিস দেব? আমার জমিতে যব, চানা, জোয়ার ছাড়া আর কীই বা পাই? আপনারা রাজার মতো মানুষ। এইসব ছোটোখাটো জিনিস আপনাদের দেওয়ার সাহস করি কী করে? আমি হলাম অতি সাধারণ একটা লোক তাই বকা খাওয়ার ডয়ে ওইসব জিনিস আনতে আমি ভয় পাই। এই জনাই, ব্লুজুর, আমি সাহস করিনি। নয় তো কিছু দুধ আর দই-এর দামই বা কত? যাকে দেওয়া হচ্ছে উপহার তার উপযুক্ত তো হওয়া উচিত।’
“আমি বলি কি তুমি কোনোদিন কিছু দেওয়ার চেষ্টা করে তো দ্যাখো লোকে কী বলে। শহরের মানুষরা তো এসব জিনিস পায় না। এইসব লোকেরা ছোটোখাটো জিনিস পেলেও খুশি হয়।”
“কিন্তু চুজুর যদি কেউ কিছু বলে? যদি কেউ অফিসের বড়োবাবুর কাছে অভিযোগ জানায়? তাহলে আমার আর কোনোই দাম থাকবে না।”
“তার দায়িত্ব আমি নিলাম, কেউ কিছু বলবে না। যদি কেউ কিছু করে আমি তাদের বুঝিয়ে বলব।”
“ঠিক আছে, হুজুর। এখন মটরশুটির চাষ হচ্ছে। চানাতে সবুজ রং ধরেছে, আখ নিগরানোর যন্ত্রও তৈরি। এ ছাড়া তো আর কিছু নেই।’
“বাস, তাহলে এগুলোই নিয়ে এস।”
“কিছু এধার ওধার হলে, হুজুর সামলাবেন তো?”
“হ্যাঁ ডহি, আমি যেমন বলেছি দেখব আমি কী করতে পারি।”
আরও পড়ুন: একাদশ শ্রেণী সটীক অনুবাদ প্রজেক্ট
পরের দিন গরিব যখন এল তার সঙ্গে তিন জন শক্তপোক্ত যুবক। তাদের দুজনের মাথায় মটরশুটির দানা ভরতি ঝুড়ি। তৃতীয় জনের মাথায় একটা বড়ো কলসি যা আখের রসে ভরতি। এদের তিন জনেরই হাতের নীচে ছিল আখের আঁটি। গরিব এসে বারান্দার সামনে একটা গাছতলায় শান্তভাবে দাঁড়াল। অফিসে আসার মতো সাহসও সে দেখাতে পারছিল না, যেন সে একটা অপরাধী। ঠিক সেই সময় পিয়ন এবং অন্যান্য কর্মচারীরা তাকে ঘিরে ধরল। এক জন একটা আখ নিয়ে চিবাতে শুরু করল, অন্যরা ঝুড়ির উপরে লাফিয়ে উঠল। সবাই কাড়াকাড়ি করতে লাগল। এই সময়েই বড়োবাবু অফিসে পৌঁছে দৃশ্যটা দেখলেন এবং কড়া গলায় বললেন, “এখানে এত ভিড় কেনা? যান, প্রত্যেকে নিজের কাজ করুন।”
আমি গিয়ে তাঁর কানে কানে বললাম, “গরিব তার বাড়ি থেকে উপহার নিয়ে এসেছে। আপনি কিছুটা নিন, কিছুটা এই লোকগুলোর মধ্যে বিলি করে নিন।”
অফিসের বড়োকর্তা রাগত ভঙ্গিতে বললেন, “গরিব তুমি এইসব জিনিস এখানে এনেছ কেন? এসব ফেরত নিয়ে যাও, নাহলে আমি ওপরতলায় রিপোর্ট করব। তুমি কি ভাব যে আমরা বোকা?”
গরিবের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে কাঁপতে লাগল, মুখে কোনো কথা নেই। অপরাধীর মতো চোখ করে সে আমার দিকে তাকাল।
আমি তার হয়ে বড়োবাবুকে বোঝাতে লাগলাম। অনেক কথা চালাচালির পর বড়োবাবু সম্মত হলেন। তিনি সবকিছুর অর্ধেকটা নিজের বাড়িতে পাঠালেন, বাকি অর্ধেক অন্যদের মধ্যে ভাগ হল। এই নাটকের এখানেই শেষ।
এবার অফিসে গরিবের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করল। এখন তাকে অনবরত বকুনি খেতে হয় না, সারাদিন দৌড়াদৌড়িও করতে হয় না। তাকে আর কর্মচারীদের কৌতুক অথবা সহকর্মীদের ব্যঙ্গ শুনতে হয় না। পিয়নরা তার কাজ করে দেয়। এমনকি তার নামও কিছুটা পালটে যায়। গরিব থেকে সে হয় গরিবদাস। তার চরিয়েও রূপান্তর ঘষ্টে। বিনয়ের জায়গায় ঔদ্ধত্য মাথাচাড়া দেয়। পরিশ্রমের জায়গা নেয় আলস্য। এখন কখনো-কখনো সে দেরি করে অফিসে আসে এবং অন্য সময়ে অসুস্থতার ডান করে বাড়িতেই থাকে। তার সব অন্যায়ই এখন জমার যোগ্য। সে এখন তার সম্মানের কারণ বুঝে নিয়েছে। প্রতি সপ্তাহে বা দু-সপ্তাহে একবার সে দুধ এবং দই নিয়ে আসে, আর অফিসের বড়োকর্তাকে তা উপহার দেয়। সে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে শিখেছে। নম্রতার বদলে গরিব এখন শয়তানি শিখে নিয়েছে।
একদিন অফিসের বড়োবাবু তাকে সরকারি ফর্মের একটি পার্সেল নিয়ে আসার জন্য স্টেশনে পাঠান। অনেকগুলি কাগজের বড়ো বড়ো বান্ডিল একটা ঠেলাগাড়িতে করে এসেছিল। গরিব ঠেলাগাড়ি চালকের সঙ্গে এগুলি পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১২ আনার রফা করল। অফিসে কাগজগুলি পৌঁছোনোর পরে বড়োকর্তার কাছ থেকে সে ঠেলাওয়ালাকে দেওয়ার জন্য ১২ আনা পয়সা নিল। কিন্তু তখনই তার ভাবনা পালটে গেল। সে তার ভাগ দাবি করল। ঠেলাওয়ালা রাজি না হওয়ায় গরিব রেগে গিয়ে পুরো পয়সাটাই নিজের পকেটে রাখল এবং ঠেলাচালককে ভয় দেখাল, “এবার তুমি আর একটা পেনিও পাচ্ছ না। যাও, যেখানে পারো অভিযোগ করো। তুমি আমার কী করতে পার দেখি।”
যখন ঠেলাওয়ালা দেখল যদি কমিশন না দেয় তাহলে সে পুরো টাকাটাই হারাতে চলেছে, তখন সে গরিবকে তখন চার আনা দিতে রাজি হল। গরিব তাকে আট আনা দিয়ে বারো আনার একটি রসিদে টিপসই দিয়ে নিল এবং সেটি অফিসে জমা করল। আমি যখন এটা দেখলাম একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। এই সেই গরিব যে কয়েকমাস আগে ছিল সারল্য আর বিনয়ের প্রতিমূর্তি। যে অন্য পিয়নদের কাছে তার ডাগের টাকার কথা বলতেও সাহস করত না, যে জানত না অন্যদের কীভাবে ঘুষ দিতে হয়, বা কীভাবে ঘুষ নেওয়ার কথা বলতে হয়। তার এই রূপান্তর দেখে আমি অত্যন্ত বিষয় হলাম। এর জন্য দায়ী কে? নিশ্চিতভাবে আমিই সেই যে তাকে ঔদ্ধত্য আর ধূর্ততার প্রথম শিক্ষা দিয়েছিলাম। মনে একটা প্রশ্ন এল-তার চরিত্রের ভীতুডাব যা অন্যের অন্যায়কে মেনে নিত সেটাই কি ভালো ছিল না অন্যকে পদদলিত করা আজকের গরিবের এই ঔদ্ধত্যের চেয়ে? যে মুহূর্তে আমি তাকে মর্যাদা আদায়ের পথটা দেখিয়েছিলাম তা ছিল একটা অশুভ মুহূর্ত, কারণ আসলে আমি তাকে পতনের পথটাই দেখিয়েছিলাম। আমি বাইরের মর্যাদার জন্য তার আত্মমর্যাদাকেই বলি দিয়েছিলাম।