বাংলার উৎসব – প্রবন্ধ রচনা

By

আজকে তোমাদের সাথে ‘বাংলার উৎসব’ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ বা প্রবন্ধ শেয়ার করলাম এটি অবশ্যই দ্বাদশ শ্রেণী পরীক্ষায় আসতে পারে । সেই উদ্দেশ্যেই আজকে তোমাদের সাথে এই বিষয়টি শেয়ার করলাম।  এই পোস্টটি পড়লে তোমরা অবশ্যই জানতে পারবে কিভাবে বাংলার উৎসব সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখতে হয়। 

বাংলার উৎসব

ভূমিকা:  বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তাই বাঙালির উৎসবের শেষ নেই। আসলে বাঙালির মানসিকতা হল দূরকে নিকট করা। এই আস্তরিকতার গুণেই সবাইকে নিয়ে উৎসবে মেতে উঠতে চায় বাঙালি। শত দুর্যোগ-দুর্বিপাকে, শোষণে অত্যাচারেও বাঙালির উৎসবপ্রিয় মানসিকতার ভাটা পড়েনি। সেজন্য ঈশ্বর গুপ্ত যথার্থই বলেছিলেন — “এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা।” শুধু তাই নয়, বাঙালির উৎসবের বৈচিত্র্যও যথেষ্ট। 

উৎসব কী:  রবীন্দ্রনাথ ‘উৎসব কি’–এ প্রসঙ্গে বলেছেন—“মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, … উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হয়ে বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করে মহৎ।”

উদ্দেশ্য:  মানুষ নিত্য-নৈমিত্তিক কাজের মধ্যে ক্ষুদ্র কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে বৃহৎ। মানুষ তার সংসার চক্রের নিরানন্দময় জীবন থেকে বাঁচবার জন্য, নিজেকে অপরের কাছে প্রকাশ করবার জন্য, শুধু প্রাণধারণের গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়ার  মানসে উৎসবের আয়োজন করেছে। উৎসবের দিনে মানুষ যেহেতু সমস্ত ক্ষুদ্রতা, হীনতা, ক্লীবতার গণ্ডীকে অতিক্রম করতে পারে, তাই সেদিন মানুষ নিজেকে অপরের মধ্যে খুঁজে পায় বলে সেদিন আনন্দের দিন। বাঙালির উৎসব তাই আনন্দ সংগীতেরই সমারোহ।

আরও পড়ুন:  বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য - প্রবন্ধ রচনা | বাংলা প্রবন্ধ রচনা 'বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যে'

উৎসবের বিবর্তন:  বৈদিক ঋষিদের সোমরস নিষ্কাশনের এক আনন্দ-উদ্বেল লোকাচার ছিল উৎসব। অন্য দিকে আদিম মানুষও শিকারের শেষে নির্দিষ্ট বাসস্থানে ফিরে এসে দলবদ্ধ হয়ে আগুন জ্বালিয়ে উৎসবের আনন্দে মেতে উঠতো। তারপর সভ্যতার অগ্রগতিতে মানুষ উৎসবের ক্ষেত্রে আরো বেশি আন্তরিক হয়ে উঠছে। মানুষ উৎসবকে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিয়েছে। তবে আগে উৎসবের মধ্যে একটা আলাদা মাহাত্ম্য ছিল। কারণ আগে উৎসবের সঙ্গে কল্যাণবোধ ও মঙ্গলবোধ জড়িত ছিল। কিন্তু আধুনিক যুগে মানুষ বড্ড বেশি যান্ত্রিক ও কৃত্রিম। সমাজে মানুষের প্রাচুর্যতার মধ্যেকার সত্তাকে করেছে বিনষ্ট। দুর্নীতি, অবক্ষয়, মূল্যবোধহীনতা মানুষের সম্পর্কের মধ্যে দেওয়াল তৈরি করেছে। আড়ম্বর ও অহংকারের মধ্যে বিলুপ্ত হতে বসেছে উৎসবের গুরুত্ব। এখন যেটুকু আছে, তা লোক দেখানো। উৎসব এখন বিপণনে পরিণত হয়েছে।

বাঙালির উৎসবপ্রিয়তা:  বাঙালির উৎসবের প্রেরণা মজ্জাগত। অবশ্য সমাজবিজ্ঞানীরা উৎসবের মৌল প্রেরণা সম্বন্ধে কয়েকটি দিকের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি : (১) ক্লান্তিকর একঘেয়েমির হাত থেকে মুক্তির পথ খোঁজা। (২) পরস্পর মিলনাকাঙ্ক্ষা। (৩) ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করা। (৪) প্রাণের আনন্দ আস্বাদনের ইচ্ছা। (৫) কর্মময় জীবনের সাফল্যের স্বীকৃতি। যেমন, আদিম মানুষ শিকার সেরে এসে উৎসবে নিজেদের মুখরিত করতো। এখনো কোনো কোনো। উপজাতির মধ্যে দেখা যায় উৎসবের সময় তারা পশুবলি দিয়ে উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা। কৃষিজীবনেও ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ‘নবান্ন’, ‘পৌষ পার্বণে’র উৎসব। সুতরাং ‘সর্বজনীন কল্যাণময় ইচ্ছা-ই’ উৎসবের মূল প্রেরণা।

উৎসবের বৈচিত্র্য:  বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যই তাদের উৎসবের বৈচিত্র্যকে সূচিত করেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ, ধর্মাচরণ, জীবনধারার বৈচিত্রানুযায়ী উৎসবের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন:-  জাতীয় উৎসবগুলিতে জাতীয় সংহতি ও ঐক্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। জাতীয় উৎসবের মধ্যে রয়েছে নানান স্মরণ অনুষ্ঠান। সেগুলি হল—স্বাধীনতা উৎসব, প্রজাতন্ত্র দিবসের উৎসব, গান্ধীজির জন্ম দিবস উদ্‌যাপন, নেতাজির জন্ম দিবস উদযাপন ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:  নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় - প্রবন্ধ রচনা | নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এর জীবনী রচনা

সামাজিক উৎসব:  বাঙালির উৎসবের মধ্যে সামাজিক উৎসব-ই সব থেকে বেশি। এই শ্রেণির উৎসবে সমাজের মানুষ বেশি করে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়। এইসব উৎসব হল বিবাহ, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, জন্মদিন পালন, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, জামাইষষ্ঠী, ভাইফোঁটা ইত্যাদি।

ধর্মীয় উৎসব:  বাঙালির ধর্মীয় চেতনা মজ্জাগত। যে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ঘিরে তাদের মধ্যে থাকে উৎসবের মেজাজ। যে কোন ধর্মের লোকেরাই যে কোন ধর্মের অনুষ্ঠানে নিজেদেরকে আনন্দে মাতিয়ে রাখে। বিশেষ করে বাঙালির দেবদেবীর অস্ত্র নেই। বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গোৎসব। সমগ্র বাংলায় এই উৎসব আলাদা আমেজ নিয়ে আসে। দুর্গাপূজায় বাঙালি শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একসঙ্গে মিশে আনন্দ করে। তাছাড়া রয়েছে বাসন্তী পূজা, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম-উৎসব জন্মাষ্টমী, জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব, ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মা পূজা এবং নানা সময়ে হরিনাম সংকীর্তন, দোল উৎসব, রাস উৎসব, ঝুলন উৎসব, শিব চতুদশী ও শিবের গাজন উৎসব এবং আরো কত কী। অন্যদিকে বাঙালি মুসলমানদের সেরা উৎসব ঈদ। ঈদ মিলনের উৎসব। সেই সঙ্গে মহরম ও অন্যান্য উৎসব। খ্রীস্টানদের বড়দিন ও গুডফ্রাইডে বড় উৎসব। বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা, শিখদের গুরু নানকের জন্মদিনও ধর্মীয় উৎসব। বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করে সব ঋতুতে বাঙালি বিভিন্ন ঋতু উৎসব পালন করে।

আরও পড়ুন:  র‍্যাগিং ও ছাত্রসমাজ - প্রবন্ধ রচনা | বাংলা প্রবন্ধ রচনা র‍্যাগিং ও ছাত্রসমাজ।

লোক উৎসব:  বাংলায় নানান ধরনের লোক উৎসব প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে বাংলার আদিবাসী জনজীবনে এইসব লোক উৎসব আজও আদিম সংস্কৃতির স্বরূপকে টিকিয়ে রেখেছে। অঘ্রাণে ধান ওঠার উৎসব নবান্ন উৎসব, পৌষে শস্যসম্ভারে ঘর ভরে ওঠার পর পিঠে পার্বণ ও তুষ তুষালি উৎসব। এছাড়া বর্ধমান,বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়াতে পালিত হয় শস্যের লোক উৎসব। যেমন—’ভাদু’, ‘টুসু, ইতু’ ইত্যাদি।

উৎসবের মূল্যায়ন:  বিশ্বায়নের প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতি যেখানে পাল্টে যাচ্ছে সেখানে উৎসবের যে পরিবর্তন হবে—তা বলাবাহুল্য। এখন উৎসবও মার্কেট বা বিপণনকেন্দ্রিক। একথা ঠিক, উৎসবকে কেন্দ্র করে বহু বৃত্তিজীবী মানুষের জীবিকার সংস্থান হয়। এদিক থেকে উৎসবের একটা অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে। কিন্তু পূর্বে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ একত্র মিলিত হত ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, বাংলার উৎসবের

মধ্যে এখন আর সেই একাত্মতা, সেই আন্তরিকতা নেই। তার পরিবর্তে আছে আড়ম্বর, জৌলুস ও কৃত্রিমতা। ফলে বর্তমানে উৎসবের মধ্যে সেই পূর্ণতাবোধ নেই।

উপসংহার:   বাঙালির উৎসবের মূল চেতনা ছিল— দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে।’ কিন্তু তা আর এখন নেই, নেই পারস্পরিক কল্যাণ কামনা। দুর্গাপূজার সময় প্রতিমা দর্শনের থেকে বড় হয়ে ওঠে কে কোন্ পোশাক বা অলংকার পরেছে তা দেখা, কিম্বা নিজেকে কে কতটা জাহির করতে পারে তার অবৈধ প্রতিযোগিতা। তাই উৎসবের গুরুত্ব স্নান হয়ে গিয়ে আনন্দকে করছে খণ্ডিত এবং মানুষের আত্মার শান্তি হচ্ছে বিঘ্নিত। তাই বাংলার উৎসব আবার সেই মিলন, মৈত্রী ও শান্তির বাণী বহন করে নিয়ে আসুক—উৎসব- পাগল বাঙালির এই হোক অন্তরের কামনা।

Leave a Comment