একটি গ্রাম্য মেলা – প্রবন্ধ রচনা করো

By

 একটি গ্রাম্য মেলা সম্পর্কে নিবন্ধ বা প্রবন্ধ রচনা করো। 

আজকে তোমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট শেয়ার করলাম। এই পোষ্টের মাধ্যমে দ্বাদশ শ্রেণীর অন্তত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবন্ধ রচনা এর বিষয় তুলে ধরলাম। আজকের এই পোস্টটি তোমাদের টেস্ট এবং ফাইনাল পরীক্ষায় অত্যন্ত ভাবে সাহায্য করতে পারে। 

একটি গ্রাম্য মেলা

ভুমিকা: “কীর্তনে আর বাউলের গানে আমরা দিয়েছি বুলি /মনের গোপনে নিভৃত ভুবনে দ্বার ছিল যতগুলি ” বাস্তবিক বাঙালির নান্দনিক দিকের পরিচয় কীর্তন ও বাউলগানে। বাউলরা উদাসী, সংসারত্যাগী ও মানবতাবাদী, তারা মানুষের কথা বলেন। এই বাউলদের সমাবেশ ঘটে প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে বীরভূম জেলার কেন্দুবিশ্ব গ্রামে অজয় নদীর তীরে। সেই উপলক্ষে শুধু বাউল নয়, বহু মানুষের জনসমাগম ঘটে ঐ প্রসিদ্ধ জায়গায়।

বাউল মেলা: অজয়ের তীরে এই বাউল মেলাকে জয়দেব স্মরণোৎসবও বলা হয়। প্রসিদ্ধ কবি ও ‘গীতগোবিন্দ’ রচয়িতা কবি জয়দেব কোনো কোনো গানের ভণিতায় নিজেকে ‘কেন্দুবিশ্বসম্ভব রোহিণীরমণ’ বলে উল্লেখ করেছেন, এই উল্লেখ এবং আনুষঙ্গিক জনশ্রুতির মাধ্যমে অজয় নদীর তীরে অবস্থিত ইলামবাজারের অন্তর্গত কেন্দুলি গ্রাম তাঁর জন্মস্থান বলে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। কিম্বদন্তী আছে, পৌষ সংক্রান্তির দিনে ভক্ত জয়দেব সুদূর কাটোয়ায় হেঁটে যেতেন, গঙ্গায় পুণ্যস্নানের জন্য। তাঁর নিষ্ঠা ও ভক্তি গঙ্গাকে বিচলিত করে। গঙ্গা জয়দেবকে জানান, বছরে একটি দিন পৌষ সংক্রান্তিতে তিনি অজয়ের সঙ্গে যুক্ত হবেন। জয়দেব সেদিন ঐখানেই স্নান করলে গঙ্গাস্নানের পুণ্য অর্জিত হবে। গঙ্গার আগমনের নিদর্শন চিহ্নিত করা যাবে ঐদিন অজয়ের স্রোতকে উজানে যেতে দেখে। এই জনশ্রুতিকে কেন্দ্র করে পৌষ সংক্রান্তিতে বাউল মেলা অনুষ্ঠিত হয়—অজয়ের তীরে।

আরও পড়ুন:  পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবনী রচনা

উৎসবের দিনের বর্ণনা: উৎসবের দিনে সকাল থেকে বহু পুণ্যার্থী মানুষ এখানে সমবেত হয়। উৎসবের প্রধান আকর্ষণ বাউল গানের মধ্যে। বহু জায়গা থেকে বাউলরা এসে মিলিত হয়। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে মিলনের মন্ত্রে সবাই সেখানে ঐ দিন একত্রিত হয়। বাউলরা গুণিযন্ত্র সহকারে গান গাইতে থাকেন। বিদেশ থেকেও বহু মানুষ এই বাউলদের সমাবেশ দেখার জন্য উপস্থিত হয়। এবং তারা টেপে তাদের গান রেকর্ড করে নিয়ে যায়। ছোট ছোট জটলায় বিভক্ত হয়ে বাউলরা আখড়ায় সমবেত হয়। সারাদিন অবিশ্রাম চলে বাউলের নাচ ও গান। রঙ-বেরঙের জোড়াতালি দেওয়া আল খাল্লা, ঘুঙুর আর গুপিযন্ত্রের তালে তালে ভেসে আসে – ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়।’ 

আরও পড়ুন:  বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ - বাংলা প্রবন্ধ রচনা | বিজ্ঞানের ভালো-মন্দ - বাংলা প্রবন্ধ রচনা | বিজ্ঞানের সুফল ও কুফল

অভিজ্ঞতা: সারা দিনরাত ধরে উৎসব চলার পর তা শেষ হয়। জেগে থাকে বুক ভরা স্মৃতি। শীতের দুঃসহ প্রবাহের মধ্যে বহু মানুষের কলকল্লোল, বাউলের নাচের ভঙ্গি আর কণ্ঠ-নিঃসৃত উদাসী গান— মানুষের মনপ্রাণ ভরিয়ে দেয়। বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের এক অপরূপ আলেখ্য রচিত হয় প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির দিন। অজয়ের তীরে এই বাউল মেলায়।

স্মরণীয় হওয়ার কারণ: আমরা জানি, মেলা হল মিলন–এই মিলন মানুষে-মানুষে। জাতপাত, শ্রেণি, ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে একত্রিত হওয়া ও পরস্পর আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিজেদেরকে উদ্দীপিত করা হল যে কোন মেলার সার্থকতা। রবীন্দ্রনাথ ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন-“আমাদের দেশ প্রধানত পল্লীবাসী। এই পল্লী মাঝে মাঝে যখন আপনার নাড়ীর মধ্যে বাহিরের বৃহৎ জগতের রক্তচলাচল অনুভব করিবার জন্য উৎসুক হইয়া উঠে, তখন মেলাই তাহার প্রধান উপায়। এই মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে করে আহ্বান। এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়—তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ। যেমন আকাশের জলে জলাশয় পূর্ণ করিবার সময় বর্ষাগম, তেমনি বিশ্বের ভাবে পল্লীর হৃদয়কে ভরিয়া দিবার উপযুক্ত অবসর মেলা।” সুতরাং মেলা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির পক্ষে একটি অপরিহার্য। উপাদান। যেখানে আমাদের দেওয়া-নেওয়ার একটি সুযোগ উপস্থাপিত হয়। সেদিক থেকে। এই বাউল মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে সমাজে ও সংস্কৃতিতে যখন প্রথাবদ্ধতা বা কূপমণ্ডুকতা এসেছে তখন সূফী সাধক, বাউল ফকিররা সেই পটভূমিকায় সমন্বয়ধর্মী উদার মতের কথা ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের মতে সব মানুষই সমান। জাতপাত, অর্থ-সম্মান দিয়ে মানুষকে যাচাই করা ঠিক নয়। তাদের সেই উদার সমন্বয়ধর্মী চিন্তাধারার প্রতিফলন এই মেলায় উপলব্ধি করে আমার মনটা ভরে গিয়েছিল। আমিও এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েছি। তৃতীয়ত, আমার মধ্যে যে অহংকার ও কুসংস্কার অনেকদিন ধরে বিভিন্ন পরম্পরায় বর্তমান ছিল তা যেন এই মেলায় এসে একটা মুক্তির পথ খুঁজে পেল।

আরও পড়ুন:  নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় - প্রবন্ধ রচনা | নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এর জীবনী রচনা

উপসংহার:  মেলা যেহেতু মিলন সাধনার ক্ষেত্র, তাই এই মেলায় আমার সেই মিলনের অভিজ্ঞতা আমার জীবনকে মুক্তির দিশা দিয়েছে। নদীমাতৃক সভ্যতায় যে কত সুন্দর উপাদান রয়েছে অজয়ের তীরে বাউলের গানে সভ্যতা ও সংস্কৃতির সেইসব উপাদান আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে, নাড়িয়ে দিয়েছে আমার চেতনাকে তাই চেতনার উন্মীলনে এই মেলা আমার জীবনের স্মৃতিকোঠায় চিরদিন অম্লান রূপে সঞ্চিত থাকবে।

Leave a Comment