ভূমিকা : মৃত্তিকা গঠনের ক্ষেত্রে কিছু উপাদানের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার রয়েছে। মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ডকুচেভ
১৮৮৯ সালে স্টেপ তৃণভূমির মাটি নিয়ে গবেষণা করার সময় তিনি মৃত্তিকা সৃষ্টির ৪ টি নিয়ন্ত্রকের
কথা বলেছেন। যথা – জলবায়ু, জীবজগৎ, শিলা ও সময়। এই চারটি নিয়ন্ত্রকের ভিত্তিতে তার দেওয়া সমীকরণটি হল : S = f(cl, o, p, t) এখানে S – মৃত্তিকা, f – কারণ বা নিয়ন্ত্রক, cl – জলবায়ু, o – জীবজগৎ, p – আদি শিলা, t – সময়। মৃত্তিকা বিজ্ঞানী জেনির মতে ডকুচেভের দেওয়া নিয়ন্ত্রক গুলির
পাশাপাশি মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূপ্রকৃতিরও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তাই তিনি বিজ্ঞানী ডকুচেভের চারটি নিয়ন্ত্রকের
পরিবর্তে মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে পাঁচটি নিয়ন্ত্রকের কথা বলেছেন। মৃত্তিকা বিজ্ঞানী জেনির মতে সমীকরণটি ছিল : S = f(cl, o, r, p, t) এখানে S – মৃত্তিকা, f – কারণ বা নিয়ন্ত্রক, cl – জলবায়ু, o – জীবজগৎ, r – ভূপ্রকৃতি, p – আদি শিলা, t – সময়।
মৃত্তিকা সৃষ্টির উপাদান : মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে যেসমস্থ উপাদানগুলি
প্রধান ভূমিকা পালন করে, সেগুলিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা – (ক) সক্রিয় উপাদান, (খ)
নিষ্ক্রিয় উপাদান।
এই দুই
উপাদানকে আবার আরও বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন – সক্রিয় উপাদানকে আরও দুই ভাগে
ভাগ করা যায়।
যথা –
জলবায়ু ও জীবজগৎ; এবং নিষ্ক্রিয় উপাদানকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা – ভূপ্রকৃতি, আদিশিলা ও সময়।
মৃত্তিকা সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক : মৃত্তিকা সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক গুলির মধ্যে কিছু তারতম্যের
কারণে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা – (A) নিষ্ক্রিয় নিয়ন্ত্রক ও (B) সক্রিয় নিয়ন্ত্রক।
মৃত্তিকা
সৃষ্টির নিয়ন্ত্রকের এই দুটি ভাগ সম্পর্কে নিন্মে আলোচনা করা হল।
(A) মৃত্তিকা
গঠনের নিষ্ক্রিয় নিয়ন্ত্রক : মৃত্তিকা গঠনের নিষ্ক্রিয় নিয়ন্ত্রক গুলি সম্পর্কে নিন্মরূপ
আলোচনা করা হল।
: মৃত্তিকার সৃষ্টির ক্ষেত্রে সর্বত্র ভূপ্রকৃতির প্রভাব সমান লক্ষ্য করা যায় না। এর মূল কারণ হল ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। যেমন –
মাধ্যমে দ্রুত মৃত্তিকা গঠন করে। তবে এক্ষেত্রে জলবায়ুর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
ভূমি : এই প্রকার ভূমিভাগে ভূমির ঢাল থাকায় বেশি কিছু পদার্থ বৃষ্টির জল বা অন্য কোন প্রক্রিয়ার
মাধ্যমে অপসারিত হলেও কিছু পদার্থ সঞ্চয়ের মাধ্যমে মাঝারি গভীরতা যুক্ত মৃত্তিকার
সৃষ্টি করে।
(গ)
অধিক ঢাল যুক্ত ভূমি : ভূমিভাগের ঢাল অধিক হওয়ায় ক্ষয়ীভূত পদার্থ সঞ্চয় এর সুযোগ
কম থাকায় সামান্য গভীরতা যুক্ত মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।
এছাড়াও ঢালের অভিমুখ, ঢালের আকৃতি, ভূমির উচ্চতা প্রভৃতি মৃত্তিকা সৃষ্টির
ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
(ii) আদি
শিলা : মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আদিশিলার ভূমিকা অপরিসীম। মৃত্তিকা বিজ্ঞানী জেনি এর মতে আদি
শিলা মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রাথমিক পদ্ধতি। আদি শিলা প্রাধান্য যুক্ত যেসব মৃত্তিকার সৃষ্টি হয় সেই
মৃত্তিকাকে এন্ডোডায়নামোমফিক মাটি বলে। মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আদি শিলার ভূমিকা গুলি হল –
(ক) মৃত্তিকার রাসায়নিক ধর্ম : আদি শিলার ওপর নির্ভর করে মৃত্তিকার রাসায়নিক
ধর্ম। যেমন -গ্রানাইট শিলা
দ্বারা গঠিত মৃত্তিকা আম্লিক প্রকৃতির এবং ব্যসল্ট শিলা দ্বারা গঠিত মৃত্তিকা
ক্ষারকীয় প্রকৃতির হয়।
(খ)
মৃত্তিকার গ্রথন : মৃত্তিকার গ্রথন আদি শিলার ওপর নির্ভরশীল। যেমন – ব্যাসল্ট শিলা থেকে সূক্ষ্ম
গ্রথন যুক্ত এটেল জাতীয় কৃষ্ণ মৃত্তিকা এবং গ্রানাইট শিলা থেকে স্থূল গ্রথন যুক্ত
বেলে মাটির সৃষ্টি হয়।
(গ)
মৃত্তিকার বর্ণ : লোহা ও ম্যাঙ্গানিজ সমৃদ্ধ মৃত্তিকা লাল এবং কোয়ার্টজ সমৃদ্ধ
মৃত্তিকা ধুসর বর্ণের হয়।
অর্থাৎ
মৃত্তিকার বর্ণ আদি শিলা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
(ঘ)
মাটির গঠন : আদি শিলার দ্বারা মৃত্তিকার উর্বরতা নিয়ন্ত্রিত হয়। আদি শিলায় চুনের পরিমাণ বেশি থাকলে
উর্বর প্রকৃতির মৃত্তিকা এবং সোডিয়াম যোগের পরিমাণ বেশি থাকলে অনুর্বর প্রকৃতির
মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।
এছাড়াও কাদা কণার পরিমাণ সৃষ্টির হার মৃত্তিকার স্থান্তর প্রভৃতি আদি শিলা
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
(iii) সময়
: আদি শিলা আবহবিকারের মাধ্যমে শিলাচূর্ণ(রেগোলিথ)এবং শিলাচূর্ণ থেকে মৃত্তিকা
সৃষ্টি পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়ে থাকে। যা মাটি সৃষ্টির সময় নামে পরিচিত। একটি আদর্শ বা পরিণত মৃত্তিকার
সৃষ্টিতে কয়েক লক্ষ্য বছর সময় লাগে। সময় এর ওপর নির্ভর করেই পরিণত, অপরিণত আবহবিকারের পরিমাণ,
জনক শিলার পরিবর্তন বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে থাকে।
মৃত্তিকাবিজ্ঞানী
মোর ১৯৬৯ সালে মৃত্তিকা গঠনের দীর্ঘসময়কালকে ৫ ভাগে ভাগ করেছেন। যথা – প্রারম্ভিক পর্যায়, তরুণ
পর্যায়, যৌবন পর্যায়, বার্ধক্য পর্যায় ও পরিণত পর্যায়।
(B) মৃত্তিকা
সৃষ্টির সক্রিয় নিয়ন্ত্রক : মৃত্তিকা সৃষ্টির সক্রিয় নিয়ন্ত্রক গুলি সম্পর্কে নিচে
আলোচনা করা হল।
(i) জলবায়ু : মৃত্তিকা সৃষ্টির উপাদানগুলির মধ্যে জলবায়ুর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ুর উপাদানগুলির মধ্যে বৃষ্টিপাত
ও তাপমাত্রা মৃত্তিকা সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। যেমন –
(ক) বৃষ্টিপাত : বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য, ধর্ম, প্রকৃতি
নির্ভরশীল। মৃত্তিকার অম্লতা,
ক্ষারত্ব, গভীরতা, নাইট্রোজেনের পরিমাণ, স্তর গঠন, কার্বোনেশন প্রভৃতি
বৈশিষ্ট্যগুলি বৃষ্টিপাত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন – অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাতের ফলে
পেডালফার শ্রেণীর অম্লধর্মী মাটি এবং বৃষ্টিপাতে পিডোক্যাল শ্রেণীর ক্ষারকীয় মাটির
সৃষ্টি হয়।
(খ)
তাপমাত্রা : মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যের ওপর বৃষ্টিপাতের মতোই তাপমাত্রা গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে থাকে।
মাটি
গঠনের হার, গভীরতা, জৈব পদার্থের পরিমাণ, কর্দম, খনিজ, সিলিকার পরিবর্তন, মাটির
প্রকৃতি তাপমাত্রার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন – অধিক তাপমাত্রার মরু অঞ্চলে শুষ্ক ও লবণাক্ত
মৃত্তিকা এবং আদ্র শীতল জলবায়ু অঞ্চলে পডসল মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।
মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে জলবায়ুর উপাদান, বায়ু প্রবাহ, তুষারপাত, বিভিন্ন
প্রকার অধক্ষেপণ ভূমিকা পালন করে।
(ii) জীবজগৎ : উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ তথা জীবজগৎ মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে উদ্ভিদজগৎ ও প্রাণীজগৎ দ্বারা আবহবিকার সংঘটিত
হয়ে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে রেগোলিথ গঠন করে এবং রেগোলিথের সাথে জৈব ও অজৈব পদার্থ
মিশ্রিত হয়ে নতুন মৃত্তিকার স্তর গঠন করে। যেমন – সরলবর্গীয় অরণ্য অঞ্চলে ডাফ মৃত্তিকার সৃষ্টি ও
পার্বত্য অঞ্চলে পডসল মৃত্তিকার সৃষ্টি জীবজগতএর ওপর নির্ভরশীল।