মার্কস-এর রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বটি আলোচনা করো।

By

উত্তর : মার্কসবাদীরা সম্পূর্ণ পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, হঠাৎই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়নি। সমাজবিবর্তনের একটি বিশেষ স্তরে উৎপাদন ব্যবস্থার চরিত্রগত পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রের আবির্ভাব হয়েছে। এঙ্গেলস্-এর মতে, অনাদি অনন্তকাল থেকে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না। একসময় এমন সব সমাজ ছিল, যেগুলি রাষ্ট্র ছাড়াই চলত আর রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। অর্থনৈতিক বিবর্তনের একটি বিশেষ পর্যায়ে যখন অনিবার্যভাবে সমাজে শ্রেণীবিভাগ এল, তখনই রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল।

রাষ্ট্র শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার : সামাজিক অগ্রগতির ধারাকে মার্কস ও এঙ্গেলস্ এর মতে চার ভাগে ভাগ করা যায়—

(i) আদিম সমভোগবাদী সমাজ : এইরূপ সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোনোপ্রকার অস্তিত্ব না থাকার ফলে শ্রেণী শোষণ ছিল না। ফলে শোষণ ব্যবস্থাকে চালু রাখার জন্য সেই সময় কোনো রাষ্ট্রযন্ত্রেরও প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হল, পণ্য বিনিময় ও শ্রমবিভাগের প্রচলন হল তখন সমাজ জীবনে এবং অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা দিল। এঙ্গেলস্-এর মতে “সভ্য সমাজে রাষ্ট্রই সমাজকে একত্রে ধরে রাখে এবং প্রত্যেকটি পর্বেই রাষ্ট্রের অবস্থান শাসকশ্রেণি পক্ষে এবং সবক্ষেত্রেই তা হল মুখ্যত শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণিতে দমন  করার যন্ত্র মাত্র”। রাষ্ট্র হল সাধারনত সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভুত্বকারী শ্রেনির রাষ্ট্র। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সংবিধান শোষক শ্রেনিকে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাতেও সহযোগিতা করে। এইভাবে নিপীড়িত সর্বহারা শ্রেণিকে শোষণ ও পীড়ন-এর হাতিয়ার ও রক্ষক হিসাবে রাষ্ট্র পুঁজিপতি শ্রেনির পক্ষে কাজ করে। দাসযুগে দাস মালিকেরা শোষণ অত্যাচার চালাতো রাষ্ট্রশক্তির মাধ্যমে। আত্ম বার সামন্তযুগে অভিজাতরা ভূমিদাসদের শোষণ করত। আর আধুনিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুঁজির লগ্নি বিনিয়োগ ইত্যাদি নানা কৌশলে শ্রমজীবী মানুষের শ্রমও মজুরি শোষণের হাতিয়ার মাত্র।

(ii) সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রকৃতি : বুর্জোয়া রাষ্ট্রে শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে সর্বহারা শ্রেনি মুক্তির জন্য বিপ্লবের পন্থা অনুসরন করে রাষ্ট্রকে শোষণের হাত থেকে মুক্ত করে সর্বহারাদের শাসক পদে অধিষ্ঠিত করে। এই চূড়ান্ত ও চরম সংগ্রামে সর্বহারা শ্রেনীর জয় হয় এবং বুর্জোয়া শক্তির পতন হয়ে ‘সর্বহারা শ্রেনির একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠা হয়। এরূপ রাষ্ট্রকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হয়। এইরূপ রাষ্ট্রে উৎপাদনের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সবাই তার শ্রমের আনুপাতিক হারে মজুরি পায়। 

এইরূপ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হল- (a) সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রমিক ও কৃষক সমাজতন্ত্রের স্বার্থে সশস্ত্র শক্তির কেন্দ্র কিন্তু জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত। (b) রাষ্ট্রের ক্ষমতাধারী প্রতিনিধি বর্গ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হবে এবং গণ ইচ্ছায় বরখাস্তও হতে পারবে। (c) সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকার ফলে আমলাতন্ত্র ছাড়াই রাষ্ট্রের সর্ববিধ সংস্কার সাধন সম্ভব। (d) এছাড়া শ্রেণী সচেতন প্রগতিশীল নেতৃত্বে রাষ্ট্ররূপ সংগঠনের কার্যক্রম গতিশীল থাকবে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কার্যাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবলুপ্তি, দেশের সম্পদ জনগণের হাতে প্রদান, জনসাধারণকে রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার দান, নারীর সম্ভ্রম ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা, জাতিবিভাজন দূর করাসহ প্রধান লক্ষ্য হল শ্রেনি শোষণের অবসান এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন।

(iii) রাষ্ট্রের অবসান : সমাজতান্ত্রিক সমাজ যখন ‘সাম্যবাদী সমাজে পরিবর্তিত হবে তখন উৎপাদনের ওপর পুঁজির নিয়ন্ত্রণ না থাকার ফলে কোনোরূপ শ্রম বিভাজন থাকবে না। সমাজে প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে এবং প্রয়োজন অনুসারে সব পাবে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রের ‘বিলুপ্তি ঘটবে’।

(iv) গুরুত্ব : মার্কসের রাষ্ট্রতত্ত্ব নানাদিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। যেমন- রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি এবং পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মার্কস শুধুমাত্র উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এছাড়া সমাজ বিবর্তনের স্তরে ধর্ম, আদর্শ, সংস্কৃতি, ন্যায়নীতি প্রভৃতি উপাদানের অপরিহার্য ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সম্পর্কিত তত্ত্বগুলির মধ্যে শুধুমাত্র মার্কসবাদই বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মার্কসবাদীরা দাবি করে থাকেন। তাঁদের মতে, সমাজ ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে মার্কসবাদীরা সমাজ পরিবর্তনের জন্য যে পথ দেখিয়েছেন, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী।
আরও পড়ুন:  এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও ।

Leave a Comment