আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের মতে, কোন বিষয়কে চেতনার কেন্দ্রীভূত করাই হলো মনোযোগ। মনোযোগ হল একপ্রকার মানসিক শক্তি, যা ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে বৃদ্ধি ঘটানো যায়। মনোযোগ হলো কোন বস্তু সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট একটি চেতনা। আর শিখনের ফলশ্রুতি হল মনোযোগ। একটি আধুনিক শিক্ষাবিদের মতে মনোযোগের সংজ্ঞা হলো – মরগান, কিং এবং রবিনসনের মতে, “মনোযোগ বলতে বোঝায় অভিজ্ঞতার ভান্ডারে নতুন কোন বিষয় সংযোজন এর জন্য কোন নির্বাচনের প্রক্রিয়া।”
➯মনোযোগের শ্রেণীবিভাগ:
মনোবিদ রস মনোযোগ কে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। তা হল –
(i) ইচ্ছা প্রশ্রুত মনোযোগ
(ii) ইচ্ছা নিরপেক্ষ মনোযোগ
মনোযোগের নির্ধারক বা শর্ত
মনোযোগ একটি জটিল মানসিক প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ শর্তের ওপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়। সাধারণত যে সব শর্ত বা উপাদান একটি ব্যক্তিকে কোন বস্তু বা ঘটনার দিকে মনোযোগী করে তোলে, সেগুলিকে মনোযোগের নির্ধারক বা শর্ত বলা হয়। মনোবিজ্ঞানীরা মনোযোগের নির্ধারককে প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন:
(A) ব্যক্তিগত বা অভ্যন্তরীণ নির্ধারক
(B) বস্তুগত বা বাহ্যিক নির্ধারক
(A) ব্যক্তিগত বা অভ্যন্তরীণ নির্ধারক:
ব্যক্তিগত নির্ধারকগুলো হলো সেই মানসিক ও শারীরিক অবস্থা, যা কোন ব্যক্তির মনোযোগ প্রভাবিত করে। এই নির্ধারকগুলি মূলত অভ্যন্তরীণ চাহিদা, আগ্রহ, অভ্যাস, এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে গঠিত। মনোযোগের ব্যক্তিগত নির্ধারকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল:
- আগ্রহ:
মনোযোগের ব্যক্তিগত নির্ধারকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো আগ্রহ। কোন ব্যক্তি যদি কোনো বিশেষ বিষয়ে আগ্রহী হয়, তবে তার মনোযোগ সেই বিষয়ের উপর স্বাভাবিকভাবেই বেশি আকৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ খেলার প্রতি আগ্রহী হয়, তবে সকালে সংবাদপত্র পড়ার সময় সে প্রথমেই খেলার খবর দেখতে চাইবে। আগ্রহ মনোযোগকে সক্রিয় ও জাগ্রত রাখে। - অভ্যাস:
অভ্যাসও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক, যা মনোযোগকে স্থিতিশীল করে রাখে। যে কোনো কার্যকলাপ যদি নিয়মিতভাবে চর্চা করা হয়, তবে সেই কার্যকলাপের প্রতি মনোযোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আকৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিদিন সকালে উঠে চা খাওয়ার অভ্যাস যাদের আছে, তারা প্রথমেই সেই অভ্যাসের প্রতি মনোযোগ দেয়। - সেন্টিমেন্ট:
সেন্টিমেন্ট বা আবেগগত ঝোঁক একটি অর্জিত মানসিক প্রবণতা, যা কোনো বিশেষ স্মৃতি বা অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত। যদি কোনো বস্তু বা বিষয়ে বিশেষ সেন্টিমেন্ট জড়িত থাকে, তবে সেই বস্তুটির প্রতি মনোযোগ বেশি আকর্ষিত হয়। এটি সাধারণত মানুষের আবেগ, স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়। - চাহিদা:
ব্যক্তিগত নির্ধারকদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত হলো চাহিদা। কোন বস্তু বা বিষয়ের চাহিদা যদি অত্যাধিক হয়, তবে সেই বস্তু বা বিষয়ের প্রতি মনোযোগ খুব সহজেই আকৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ, খাদ্য গ্রহণের তীব্র চাহিদা থাকলে, খাদ্যের প্রতি মনোযোগ স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। - পূর্ব অভিজ্ঞতা:
পূর্ব অভিজ্ঞতাও মনোযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। পূর্বের কোনো অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি যদি কোন ভুল সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা মনে করিয়ে দেয়, তবে সেই বিষয়ের প্রতি মনোযোগ বেশি করে আকৃষ্ট হয়। এটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং শিখনের উপর ভিত্তি করে গঠিত।
(B) বস্তুগত বা বাহ্যিক নির্ধারক:
বস্তুগত নির্ধারকগুলো হলো সেই বাহ্যিক উপাদান বা বৈশিষ্ট্য, যা কোন বস্তুর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই নির্ধারকগুলি সাধারণত বস্তুটির ভৌত বৈশিষ্ট্য এবং পরিবেশের উপর ভিত্তি করে গঠিত। মনোযোগের বস্তুগত নির্ধারকদের মধ্যে কয়েকটি প্রধান উপাদান হল:
- সুস্পষ্টতা:
কোন বস্তু যদি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান বা বোধগম্য হয়, তবে সেটি মনোযোগ আকর্ষণ করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি অস্পষ্ট চিত্রের তুলনায় একটি স্পষ্ট চিত্র আমাদের মনোযোগকে বেশি আকর্ষণ করবে। সুস্পষ্টতা মানসিক প্রক্রিয়াকে সরল এবং কার্যকর করে তোলে। - নতুনত্ব:
নতুনত্ব বা উদ্ভাবনশীলতা হলো এমন একটি উপাদান, যা সহজেই মনোযোগ আকর্ষণ করে। কোন নতুন বস্তু বা ঘটনা যখন প্রথমবারের জন্য প্রকাশিত হয়, তখন সেই নতুনত্ব আমাদের মনোযোগকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি নতুন মোবাইল ফোন কেনার পরে সেই ফোনটি বেশ কয়েকদিন ধরে আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। - তীব্রতা:
কোনো বস্তুর উজ্জ্বলতা বা তীব্রতা মনোযোগ আকর্ষণ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যেমন, যদি একটি জামার উজ্জ্বলতা বেশি হয়, তবে সেটি আমাদের চোখে প্রথমে পড়বে এবং মনোযোগ আকর্ষণ করবে। - পরিবর্তনশীলতা:
পরিবর্তনশীলতা বা বৈচিত্র্য মনোযোগ আকর্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। স্থির পরিবেশে কোনো অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটলে, সেই পরিবর্তন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি শান্ত পরিবেশে হঠাৎ হাসির শব্দ আমাদের মনোযোগকে দ্রুত আকর্ষণ করে। - গতিশীলতা:
স্থির বস্তুর তুলনায় গতিশীল বস্তুর প্রতি আমাদের মনোযোগ সহজেই আকৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোন রাস্তায় সবাই হেঁটে চলেছে, কিন্তু একজন ব্যক্তি হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করে, তবে সেই ব্যক্তির দিকে আমাদের মনোযোগ চলে যাবে।
শিক্ষাক্ষেত্রে মনোযোগের গুরুত্ব
শিক্ষাক্ষেত্রে মনোযোগ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা শিক্ষার্থীর শেখার প্রক্রিয়া, একাগ্রতা, এবং শিক্ষাগত সাফল্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। মনোযোগ ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব। মনোযোগ শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জন, দক্ষতা উন্নয়ন এবং শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুর প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করে। নিচে শিক্ষাক্ষেত্রে মনোযোগের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. শেখার কার্যকারিতা বৃদ্ধি: মনোযোগ শিক্ষার্থীর শেখার কার্যকারিতা বহুগুণে বৃদ্ধি করে। যখন শিক্ষার্থী মনোযোগ সহকারে পাঠ্যবস্তু অধ্যয়ন করে, তখন তার মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতা বাড়ে, যা নতুন ধারণা ও তথ্য দ্রুত শিখতে সহায়ক হয়। মনোযোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থী তথ্যগুলো ভালোভাবে মনে রাখতে এবং তা প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়।
২. মনে রাখার ক্ষমতা উন্নয়ন: মনোযোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থী পাঠ্যবস্তুকে সঠিকভাবে মনে রাখতে পারে। শিক্ষার কোনো বিষয়বস্তু যদি মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করা হয়, তবে তা দীর্ঘ সময়ের জন্য মনে থাকে এবং পরীক্ষার সময়েও সহজে মনে পড়ে। মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করলে স্মৃতিশক্তি উন্নত হয় এবং শিক্ষার্থী বেশি সময় ধরে তথ্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
৩. একাগ্রতা ও ধৈর্য বৃদ্ধি: মনোযোগ শিক্ষার্থীর একাগ্রতা ও ধৈর্য বাড়াতে সহায়ক। মনোযোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট বিষয় বা সমস্যার উপর গভীরভাবে চিন্তা করতে সক্ষম হয়, যা সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বাড়ায়। একাগ্রতা ও ধৈর্যের অভাব শিক্ষার্থীর শিক্ষার প্রতি অনীহা তৈরি করতে পারে, যা মনোযোগ দিয়ে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
৪. বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি: মনোযোগ সহকারে কোনো বিষয় শেখা শিক্ষার্থীর বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়ায়। মনোযোগ দিয়ে শিখলে শিক্ষার্থী কোনো বিষয়কে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে এবং সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়। এটি তার সমালোচনামূলক চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে শাণিত করে।
৫. উৎসাহ ও আগ্রহের উন্নয়ন: মনোযোগ শিক্ষার্থীর শিক্ষার প্রতি উৎসাহ ও আগ্রহ বাড়ায়। যদি কোন শিক্ষার্থী মনোযোগ সহকারে কোনো বিষয় শিখে, তবে তার মধ্যে সেই বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এই আগ্রহ শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে এবং শিক্ষার্থী নতুন বিষয় শিখতে উৎসাহিত হয়।
৬. ভুল কমিয়ে আনা: মনোযোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থী পাঠ্যবস্তু বুঝতে ভুল করে না। মনোযোগ দিয়ে কোনো বিষয় শিখলে শিক্ষার্থী সেই বিষয়বস্তুতে গভীরভাবে মনোনিবেশ করে এবং ভুল বোঝাবুঝি বা ভুল তথ্য ধারণা কম হয়। এর ফলে শিক্ষার্থী পরীক্ষা বা অন্যান্য ক্ষেত্রে ভুল কম করে এবং ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারে।
৭. আত্মনিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা: মনোযোগ শিক্ষার্থীর আত্মনিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক। মনোযোগ দিলে শিক্ষার্থী নিজের কাজের প্রতি মনোযোগী থাকে এবং অপ্রয়োজনীয় বা বাহ্যিক বিভ্রান্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা শিক্ষার ক্ষেত্রে তার উন্নতির পথকে সহজ করে তোলে।
উপসংহার:
সবশেষে বলা যায়, মনোযোগ হল একটি জটিল মানসিক প্রক্রিয়া, যা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে সুস্পষ্ট চিন্তার মাধ্যমে মনের সামনে তুলে ধরে। মনোযোগের বিভিন্ন নির্ধারক যেমন বাহ্যিক তীব্রতা, অভ্যন্তরীণ আগ্রহ বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমাদের মনোযোগকে প্রভাবিত করে। মনোযোগ শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়ায়, ব্যক্তিগত জীবনে এবং সামাজিক আচরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মনোযোগের সঠিক ব্যবহারই আমাদের জীবনকে কার্যকর ও সফল করে তোলে।
শিক্ষাক্ষেত্রে মনোযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। মনোযোগ শিক্ষার্থীকে কার্যকরভাবে শেখার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করে, যা তাকে তার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। শিক্ষার প্রতি মনোযোগ ধরে রাখা এবং তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি। তাই, প্রতিটি শিক্ষার্থীর উচিত মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করা এবং তা ধরে রাখা, যাতে সে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফল হতে পারে।