ভূমিকা : সংবিধানের ৫৩ এর (1) নং ধারা অনুযায়ী ভারতে রাষ্ট্রপতি শাসন বিভাগের সর্বময় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রীসভার পরামর্শ মত পরিচালিত হতে বাধ্য বলে কার্যত তিনি নিয়মতান্ত্রিক বা নামসর্বস্ব শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত। একক-হস্তান্তরযোগ্য ভোটের ভিত্তিতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এর মাধ্যমে একটি নির্বাচক সংস্থা কর্তৃক গোপন ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পরোক্ষভাবে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন।
ক্ষমতাসমূহ :
(1) শাসনসংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতির শাসনসংক্রান্ত ক্ষমতা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আত্ম লোচনা করা যায় — (i) কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রকার শাসনকার্য রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয়। (ii) কেন্দ্রের সমস্ত কাজ ও আইন তৈরির পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করা অর্থাৎ মন্ত্রীসভার যাবতীয় সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে রাষ্ট্রপতি জ্ঞাত হবেন। (iii) অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল, অ্যাটর্নি জেনারেল ও জনপালন কৃত্যক কমিশনের সভাপতি সহ সদস্যদের তিনি পদচ্যুত করতে পারেন। (iv) প্রতিটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য তিনি প্রশাসক নিয়োগ করতে পারেন।
(2) সামরিক ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক তিনি স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ করেন। পার্লামেন্ট ও ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি যুদ্ধ ঘোষণা কিংবা শান্তি স্থাপন করতে পারেন।
(3) কূটনৈতিক ক্ষমতা : রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন রাষ্ট্রে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের প্রেরণ করেন। বিদেশী রাষ্ট্রদূতেরা তাঁর কাছে নিজ নিজ পরিচয়পত্র পেশ করেন এবং তিনি তাঁদের গ্রহণ করেন। বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ধি, চুক্তি তাঁর নামেই সম্পাদিত হয়।
(4) আইন বিষয়ক ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তিনি পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করতে বা স্থগিত রাখতে পারেন। কার্যকাল শেষ হওয়ার পূর্বে তিনি লোকসভা ভেঙে দিতে পারেন। প্রয়োজনে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের যৌথ অধিবেশন ডাকতে পারেন। সাধারণ নির্বাচনের পরে তিনি আইনসভার উভয় কক্ষে ভাষণ দেন। রাজ্যসভায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ১২ জনকে মনোনীত করতে পারেন। লাকসভায় ২ জন ইঙ্গ-ভারতীয় সদস্যকে মনোনীত করেন। পার্লামেন্ট কর্তৃক গৃহীত প্রতিটি বিল তাঁর সম্মতির জন্য পাঠানো হয়। অর্থবিল ছাড়া অন্যান্য বিলে তিনি সম্মতি নাও দিতে পারেন। তবে পুনরায় পার্লামেন্ট কর্তৃক উক্ত বিল গৃহীত হলে তিনি সম্মতি দিতে বাধ্য থাকেন। রাজ্য বিধানসভায় গৃহীত কোনো বিলে তিনি সম্মতি নাও দিতে পারেন। পার্লামেন্টের অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন তিনি ‘অর্ডিন্যান্স’ জারি করতে পারেন। পরে অবশ্য ‘অর্ডিন্যান্স কে পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত হতে হয় নচেৎ বাতিল হয়ে যায়। এছাড়া কোনো রাজ্যের সীমানা বা নাম পরিবর্তন, নতুন রাজ্য গঠনের প্রস্তাব, অর্থ কমিশন সুপারিশ, অর্থবিল সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির নির্দেশ বা পূর্বসম্মতি সাপেক্ষে পার্লামেন্টে উপস্থাপিত হতে পারে।
(5) অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতির অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতাগুলি হল- (i) অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রত্যেক বছরের জন্য পার্লামেন্টে বাজেট পেশ করা। (ii) তাঁর সুপারিশ ছাড়া কোনো ব্যয় মঞ্জুরি প্রস্তাব, অর্থবিল প্রভৃতি পার্লামেন্টে পেশ করা যায় না। এছাড়া তাঁর পূর্ব সুপারিশ ছাড়া কর, ঋণ প্রভৃতি বিষয়ক বিল পার্লামেন্টে উত্থাপন করা যায় না। (iii) কেন্দ্র-রাজ্য রাজস্ব বণ্টনের জন্য প্রতি ৫ বছর অন্তর তিনি অর্থ কমিশন গঠন করেন।
(6) বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা : (i) সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের তিনি নিয়োগ করেন এবং পার্লামেন্টের সুপারিশে তাঁদের পদচ্যুত করতে পারেন। (ii) এছাড়া অপরাধীকে ক্ষমা করা, শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির শাস্তি হ্রাস বা স্থগিত করা, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীকে ক্ষমা করা বা শাস্তি হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে।
(7) নিয়োগসংক্রান্ত ক্ষমতা : প্রধানমন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, অ্যাটর্নি জেনারেল, ব্যয়-নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক, নির্বাচন কমিশনার, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সদস্য, অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল প্রমুখ পদাধিকারীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন।
(8) জরুরী অবস্থা জারিসংক্রান্ত ক্ষমতা : সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তিন ধরনের জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন। যথা –
(i) জাতীয় জরুরি অবস্থা : সংবিধানের ৩৫২ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ, অতিমারী, বিপর্যয় বা অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র বিদ্রোহের ফলে দেশের স্থায়িত্ব বিঘ্নিত হতে পারে, তাহলে তিনি সমগ্র দেশে বা দেশের কোন অংশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।
(ii) রাজ্যে সাংবিধানিক অচলাবস্থার ক্ষেত্রে : কোনো রাজ্যের রাজ্যপালের রিপোর্ট বা অন্য কোন সূত্র থেকে পাওয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি যদি ওই রাজ্যে সাংবিধানিক অচলাবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হন তাহলে ৩৫৬ নং ধারা অনুযায়ী ওই রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করতে পারেন।
(iii) আর্থিক জরুরি অবস্থা : সংবিধানের ৩৬০ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে ভারতের বা ভারতের কোনো অংশের আর্থিক স্থায়িত্ব বিনষ্ট হয়েছে বা অতিমারি, মহামারি অথবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে সেক্ষেত্রে তিনি আর্থিক জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন।
(9) অন্যান্য ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতিকে আরও যেসব কার্যাবলী সম্পাদন করতে হয় সেগুলি হল ঃ- (i) নানাবিধ বিষয়ে নিয়মাবলী প্রণয়ন। (ii) জনস্বার্থে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ। (iii) যে কোনো অঞ্চলকে তপশিলি অঞ্চল বা কোনো তপশিলি অঞ্চলকে অ-তপশিলি অঞ্চল বলে ঘোষণা করা, তপশিলি অঞ্চলের সীমানা পরিবর্তন করা, ইত্যাদি। ভারতে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত থাকায় রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে আসীন থাকলেও তিনি নিয়মতান্ত্রিক শাসক। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রীসভার পরামর্শে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।