উত্তর : সংবিধানের [164 (i)] নং ধারা অনুযায়ী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়োগ করেন রাজ্যপাল। বিধানসভার নির্বাচনের পর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা মোর্চার নেতা বা নেত্রীকে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ করেন। তবে কোনো দল বা মোর্চা যদি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না পায় তাহলে রাজ্যপাল তাঁর বিবেচনা মতো কাউকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ করতে পারেন ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য বলতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রীকে আইনসভার সদস্য হতে হয় (দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট রাজ্য আইনসভা হলে, যে কোনো কক্ষের) এবং তাঁর কার্যকাল পাঁচ বছর।
(1) রাজ্য বিধানসভার নেতা ও নেত্রী : রাজ্য বিধানসভার নেতা বা নেত্রী হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভার অধিবেশন আহ্বান, স্থগিত রাখা এবং প্রয়োজনে ভেঙে দেওয়ার জন্যও রাজপালকে পরামর্শ দিতে পারেন। রাজ্য সরকারের প্রধান হিসাবে সভায় সরকারি নীতি,কার্যক্রম ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেন। বিধানসভায় কোনো প্রস্তাবের উপর বিতর্ক ও আলোচনা চলাকালীন কোনো মন্ত্রী অসুবিধায় পড়লে তিনি তাঁকে সাহায্য করেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে রাজ্যের উন্নয়নে গৃহীত যাবতীয় সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা তাঁকেই করতে হয়। বিরোধী পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ ও আইনসভার কাজ যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে সেই দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। বিধানসভায় মন্ত্রীসভার গরিষ্ঠতা সম্পর্কে প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার জন্য রাজ্যপালকে পরামর্শ দিতে পারেন। তবে রাজ্যপাল তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতেও পারেন বা নাও করতে পারেন।
(2) মন্ত্রীসভার নেতা বা নেত্রী : যদিও মুখ্যমন্ত্রীকে ‘সমমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রগণ্য’ বলা হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য মন্ত্রীসভার প্রধান হিসাবে প্রভূত ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শেই রাজ্যপাল মন্ত্রীসভার সদস্যদের নিয়োগ করেন ও দপ্তর বণ্টন করেন। কোনো মন্ত্রীকে পদচ্যুত করার ক্ষমতাও রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর। বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় ও মন্ত্রীসভার ঐক্য বজায় রাখার দায়িত্ব তাঁর। মন্ত্রীসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন তিনি এবং মন্ত্রীদের একক ও যৌথ যে কোনো সিদ্ধান্ত তাঁর চূড়ান্ত সম্মতি সাপেক্ষে গৃহীত হয়। তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীনেই মন্ত্রীসভা পরিচালিত হয় ।
(3) সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা মোর্চার নেতা বা নেত্রী : বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের নেতা বা নেত্রী হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীকে নিজের দল বা মোর্চার ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখ তে হয় এবং দল বা মোর্চার কার্যকলাপ তথা বিতর্ক ও আলোচনা যাতে জনমুখী হয় সে দিকেও লক্ষ রাখতে হয়। সরকার ও সরকারি দল বা মোর্চার সাফল্য মুখ্যমন্ত্রীর কর্মদক্ষতা ও সক্রিয়তার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। দলীয় শৃঙ্খলাও বজায় রাখার দায়িত্ব তাঁর।
(4) রাজ্যপালের প্রধান পরামর্শদাতা : সংবিধান অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ মতো রাজ্যপাল রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। রাজ্যপাল ও মন্ত্রীসভার মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হলেন মুখ্যমন্ত্রী। মন্ত্রীসভার সকল সিদ্ধান্ত রাজ্যপালকে জ্ঞাত করার দায়িত্ব তাঁর। শাসনসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে রাজ্যপাল জানতে চাইলে তাঁকে সে বিষয়ে অবহিত করার দায়িত্বও মুখ্যমন্ত্রীর।
(5) নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল, রাজ্য জনকৃত্যক কমিশনের সভাপতি ও সদস্যদিগকে নিয়োগের পরামর্শ মুখ্যমন্ত্রীই রাজ্যপালকে দিয়ে থাকেন। এছাড়া রাজ্যের প্রশাসনিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন কমিটি, কমিশনের চেয়ারম্যান, সদস্য প্রভৃতি নিয়োগের সুপারিশ মুখ্যমন্ত্রীই করেন। সকল নিয়োগেই মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশ মতো করতে রাজ্যপাল বাধ্য থাকেন।
(6) অন্যান্য কার্য : মুখ্যমন্ত্রীকে সর্বদা জনমতের দিকে লক্ষ রেখে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। বিভিন্ন সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সরকারের কার্যকরী সদিচ্ছার নিদর্শন রাখেন। তিনি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে রাজ্যের সমস্যাবলী সম্পর্কে আলোচনা করে তার প্রতিকারের আশ্বাস দিয়ে জনমতকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। অতএব রাজ্যের যাবতীয় কর্মকাণ্ড মুখ্যমন্ত্রীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।
পদমর্যাদা : কেন্দ্রের ন্যায় রাজ্যে ও সংসদীয় শাসনব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে এবং মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বেই রাজশাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। ভারতের সংবিধানে উল্লেখিত রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়গুলিই রাজ্য প্রশাসনের ক্ষমতার উৎস। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য মন্ত্রীসভার নেতা হিসাবে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। তবে রাজ্যপালের কিছু ‘স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকার দরুণ কিছু ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা থাকে। তবে স্বাভাবিক অবস্থায় রাজপাল নেহাতই নিয়মতান্ত্রিক শাসক এবং মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ মতোই তাঁকে রাজ্যশাসন করতে হয়। তবে মুখ্যমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব অনেকাংশে নির্ভর করে রাজ্য বিধানসভায় সরকারি দলের গরিষ্ঠতা, দল বা মোর্চার উপর তাঁর কর্তৃত্ব, কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের সরকার প্রভৃতি পরিস্থিতি ও বিষয়ের ওপর। তবে মুখ্যমন্ত্রীর পান্ডিত্য, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, লোকশ্চরিত্রজ্ঞান, গণসম্মোহন ভাবমূর্তি, চরিত্রগত দৃঢ়তা, সমদৃষ্টি ইত্যাদি তাঁর পদমর্যাদাকে বৃদ্ধি করে।