ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের গঠন ও কার্যাবলী ব্যাখ্যা করো।

By

ভারতীয়  সুপ্রিম কোর্টের গঠন ও কার্যাবলী :

ভারতের অখণ্ড বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছে সুপ্রিমকোর্টের সংবিধানের ১২৪-১৪৭ ধারা সমূহের মধ্যে সুপ্রিমকোর্ট সম্বন্ধে যাবতীয় আলোচনা করা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের  গঠন : সুপ্রিম কোর্ট ১ জন প্রধান বিচারপতি ও ৩০ জন অন্যান্য বিচারপতি নিয়ে গঠিত হবে বলে সংবিধানে উল্লেখ আছে। বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা ২৮ জন। এছাড়া প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতির অনুমতি সাপেক্ষে অস্থায়ী বিচারপতি নিযুক্ত হতে পারে। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি হওয়ার যোগ্যতাগুলি হল – (1) ভারতীয় নাগরিক হতে হবে (2) কমপক্ষে ৫ বছর কোনো হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে কর্মরত থাকতে হবে অথবা ১০ বছর একাদিক্রমে কোনো হাইকোর্টে আইনজীবি হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অথবা রাষ্ট্রপতির মতে তাঁকে একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ হতে হবে।

সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন। সুপ্রিমকোর্টের অন্যান্য বিচারপতিদের নিয়োগের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচার পতির সঙ্গে পরামর্শ করেন। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচলিত দুটি প্রথা হল বিচারপতিদের মধ্যে একজন মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত হবেন এবং বিচারপতিদের মধ্যে প্রবীণতম বিচারপতি প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিযুক্ত হবেন।

সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্বপদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারেন। সংবিধানভঙ্গ বা প্রমাণিত গুরুতর অভিযোগের ভিত্তিতে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের মোট সদস্যের উপস্থিত ও ভোটদানকারী দুই তৃতীয়াংশের সমর্থনে কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করা যায়। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন, ভাতা ইত্যাদি পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।

আরও পড়ুন:  ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো।

ক্ষমতা ও কার্যাবলী : সুপ্রিমকোর্টের কার্যাবলী মূলত চারভাগে ভাগ করা যায়। যথা— (1) মূল এলাকা (2) আপিল এলাকা (3) পরামর্শ দান এলাকা (4) নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারি করার এলাকা।

(1) মূল এলাকাভুক্ত ক্ষমতা : সুপ্রিমকোর্ট মূল এলাকাভুক্ত যেসব বিরোধের মীমাংসা করতে পারে সেগুলি হল— (a) আইনগত অধিকারের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার এবং এক বা একাধিক রাজ্য সরকারের সঙ্গে অন্য কয়েকটি বা একটি রাজ্য সরকারের বিরোধ দেখা দিলে, দুই বা তার বেশি রাজ্য সরকারের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ দেখা দিলে সে বিষয়ের সাংবিধানিক ব্যাখ্যাসহ বিরোধ নিষ্পত্তি করা। এছাড়া রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো বিরোধ বা প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিলে সুপ্রিমকোর্টেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। সুপ্রিমকোর্টকে ‘ভারতের সংবিধানের রক্ষাকর্তা এবং ব্যাখ্যাকর্তা বলে অভিহিত করা হয়।

(2) আপিল এলাকাভুক্ত ক্ষমতা : দেশের সর্বোচ্চ আপিল আদালত সুপ্রিমকোর্টের এই ক্ষমতাকে চার ভাগে আলোচনা করা যায়-

(a) সংবিধানের ব্যাখ্যাসংক্রান্ত আপিল : কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি কিংবা অন্য যে কোনরূপ মামলায় হাইকোর্ট যদি সার্টিফিকেট দেয় যে সংশ্লিষ্ট মামলাটির সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যাসংক্রান্ত কোনো বিষয় জড়িত আছে তাহলে সেই ক্ষেত্রে  সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়। বিশেষ পরিস্থিতিতে সংবিধানের ব্যাখ্যাসংক্রান্ত যেকোনো মামলা বিচারের জন্য সুপ্রিমকোর্ট নিজেই আপিল করার ‘বিশেষ অনুমতি’ দিতে পারে।

আরও পড়ুন:  আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে কী বোঝ? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতির মধ্যে পাথক্য কী?

(b) দেওয়ানি আপিল : এইরূপ আপিলের ক্ষেত্রগুলি হল কোনো দেওয়ানি মামলার সঙ্গে আইনের সাধারণ প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রশ্ন জড়িত থাকলে, বা কোনো দেওয়ানি মামলার বিচার সুপ্রিমকোর্টে হওয়া উচিৎ বলে হাইকোর্ট মনে করলে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়।

(c) ফৌজদারি আপিল : ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের যে সব রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায় সেগুলি হল – (i) নিম্ন আদালতে নির্দোষ কোনো ব্যক্তিকে হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড দিলে (ii) হাইকোর্ট যদি মনে করে কোনো মামলা সুপ্রিম কোর্টে আপিল যোগ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে। এছাড়া পার্লামেন্ট আইনের প্রনয়নের মাধ্যমে ফৌজদারি বিষয়ক মামলায় সুপ্রীম কোর্টকে অধিকতর ক্ষমতা প্রদান করতে পারে।

(d) বিশেষ অনুমতির মাধ্যমে আপিল : সুপ্রিমকোর্ট ভারতের যে কোনো আদালতের যে কোনো রায়, আদেশ ও শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করার ‘বিশেষ অনুমতি’ দিতে পারে। অবশ্য সামরিক আদালত বা ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে আপিল করা যায় না।

(3) পরামর্শদান-সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতি কিছু আইনসংক্রান্ত প্রশ্নে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। যেমন- (i) আইন বা তথ্যসংক্রান্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে কিছু এক্ষেত্রে পরামর্শদান সুপ্রীমকোর্টের ইচ্ছাধীন। (ii) সংবিধান কার্যকর হওয়ার পূর্বে সম্পাদিত সন্ধি, চুক্তি, অঙ্গীকার পত্র, সনদ প্রভৃতির মধ্যে যেগুলি সংবিধান চালু হওয়ার পরেও বলবৎ আছে, সেইসব বিষয়ে কোন বিরোধ দেখা দিলে রাষ্ট্রপতির অনুরোধে সুপ্রীমকোর্ট পরামর্শ দিতে বাধ্য। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কোনো পরামর্শ গ্রহণেই বাধ্য নন।

আরও পড়ুন:  ভারতের অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা ব্যাখ্যা করো।

(4) নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারির ক্ষমতা : সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলি নাগরিক স্বার্থে সংরক্ষণ করার জন্য সুপ্রিমকোর্ট বন্দি-প্রত্যক্ষীকরণ, পরমাদেশ, প্রতিষেধ, অধিকারচ্ছা, উৎপ্রেষণ প্রভৃতি নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারি করার অধিকারী। তবে জরুরি অবস্থার সময়ে সুপ্রিমকোর্টের এই অধিকার স্থগিত থাকে।

(5) অন্যান্য ক্ষমতা : সুপ্রিমকোর্টের অন্যান্য আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা রয়েছে। যথা- (i) সুপ্রিমকোর্ট অভিলেখ আদালত হিসাবে কাজ করে। (ii) সুপ্রিমকোর্ট তার নিজের দেওয়া আদেশ পুনর্বিবেচনা করতে পারে। (iii) সুপ্রিমকোর্ট তার অবমাননাকারীকে শাস্তি দিতে পারে। (iv) সুপ্রিমকোর্ট সমগ্র দেশে ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজনীয় আদেশ জারি করতে পারে। ভারতের সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলীর গভীরতা পর্যালোচনা করে একে আয়ার বলেছিলেন, ভারতের সুপ্রিমকোর্ট পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু বাস্তবে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টের ন্যায় অত্যধিক শক্তিশালী নয় আবার ব্রিটেনের সর্বোচ্চ আদালতের ন্যায় দুর্বলও নয়। তবে সুপ্রিমকোর্ট সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসাবে পথ প্রদর্শক হলেও অতি সম্প্রতি কোর্টের কিছু রায় সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ থাকায় বিচার বিভাগের আরও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ মূলক ভূমিকার কথা বিদ্বজনমহল মতপ্রকাশ করেছেন।

Leave a Comment