ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো।

By

ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী :

রাষ্ট্রপতি, রাজ্যসভা ও লোকসভা নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা গঠিত। উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা অনধিক ২৫০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হতে পারে এবং বর্তমান সদস্য সংখ্যা ২৪৫ জন। লোকসভা অনধিক ৫৫২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হতে পারে এবং বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫৪৫ জন। ভারতের উপরাষ্ট্রপতি রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসাবে সভার কাজ পরিচালনা করেন। আর লোকসভার সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত লোকসভার অধ্যক্ষ সভায় সভাপতিত্ব করেন। রাজসভা স্থায়ী কক্ষ এবং সদস্যদের কার্যকাল ৬ বছর। অন্যদিকে লোকসভার স্বাভাবিক মেয়াদ ৫ বছর।

ক্ষমতা ও কার্যাবলী : ভারতীয় পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ও কার্যাবলী হল—

(1) আইন প্রণয়নের ক্ষমতা : সংবিধানে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে তিনটি তালিকা বিদ্যমান। যথা কেন্দ্রীয় তালিকা, রাজ্য তালিকা ও যুগ্ম তালিকা। তন্মধ্যে কেন্দ্ৰীয় তালিকাভুক্ত ১০০টি বিষয়ে পার্লামেন্ট এককভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারে। আর যুগ্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত ৫২টি বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়েই আইন প্রণয়ন করতে পারে। তবে যুগ্মতালিকার অন্তর্ভুক্ত কোনো বিষয়ে রাজ্য আইন ও কেন্দ্রীয় আত্ম ইনের বিরোধ দেখা দিলে কেন্দ্রীয় আইনসভা প্রনীত আইনই গ্রাহ্য হবে। তাছাড়া অবশিষ্ট বিষয়ে আইন প্রণয়নের অধিকারও পার্লামেন্টের রয়েছে। দেশে জরুরি অবস্থা জারি থাকলে বা রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হলে রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়েও পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক সন্ধি, চুক্তি ইত্যাদির শর্তাদি সাপেক্ষে, দুই বা ততোধিক রাজ্যের অনুরোধক্রমে পার্লামেন্ট রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে।

আরও পড়ুন:  আধুনিক রাষ্ট্রে শাসনবিভাগের কার্যাবলী আলোচনা করো।

(2) মন্ত্রীসভা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা : প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ পার্লামেন্টের যে কোনো কক্ষের সদস্যদিগের মধ্য থেকে নিযুক্ত হতে পারেন। তবে মন্ত্রীসভার সদস্যদের অবশ্যই পার্লামেন্টের সদস্য হতে হয়। পার্লামেন্টের সদস্য নয় এমন ব্যক্তি মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁকে ছয় মাসের মধ্যে পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়ে আসতে হয়। মন্ত্রীসভার ওপর পার্লামেন্টের সব চাইতে বড় নিয়ন্ত্রণ হল মন্ত্রীসভাকে সর্বদা নিম্নকক্ষ লোকসভার আস্থাভাজন থাকতে হয়। লোকসভার আস্থা হারালে  সরকারের পতন হয়। অর্থবিল ছাড়া অন্যান্য সব বিল পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে পাস না হলে আইনে পরিণত হয় না। তাই লোকসভায় গরিষ্ঠতা থাকলেও অনেক সময় রাজ্যসভায় সরকারের গরিষ্ঠতা না থাকলে আইন পাসের ক্ষেত্রে সরকারকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এইভাবে মন্ত্রীসভা গঠন, নিয়ন্ত্রণ ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পার্লামেন্ট মন্ত্রীসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

(3) শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ : পার্লামেন্টে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, প্রস্তাব উত্থাপন, বিতর্ক, কোনো বিলের ওপর আলোচনা, নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ, অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন প্রভৃতির মাধ্যমে বিরোধী দল শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট ইত্যাদি পার্লামেন্টে আলোচনা, সমালোচনার মাধ্যমেও শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

আরও পড়ুন:  ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের গঠন ও কার্যাবলী ব্যাখ্যা করো।

(4) অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতা : অর্থবিল শুধুমাত্র লোকসভাতেই উত্থাপন করা যায়। কোনো বিল অর্থবিল কিনা সে বিষয়ে লোকসভার স্পিকারের মতামতই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। অর্থবিলের ব্যাপারে রাজ্যসভার কোনো ভূমিকা নেই। প্রথা মাফিক অর্থবিল রাজ্যসভায় প্রেরিত হয় এবং ১৪ দিনের মধ্যে ফেরৎ না হলে উভয় কক্ষে তা গৃহীত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। নতুন কর ধার্য, পুরানো করের পুনর্বিন্যাস, কোনো করের বিলোপসাধন প্রভৃতি ব্যাপারে লোকসভা তথা পার্লামেন্টের অনুমোদন একান্ত আবশ্যিক। লোকসভার অনুমোদন ব্যতীত সরকার কোনরূপ অর্থব্যয় করতে পারে না।

(5) নির্বাচন ও পদচ্যুত করার ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের নির্বাচিত সদস্যরা ভোটদানের অধিকারী। উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন শুধুমাত্র পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের সদস্যদের দ্বারাই অনুষ্ঠিত হয়। উপরাষ্ট্রপতির পদচ্যুতিও পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুত করার জন্য ‘মহাবিচার পদ্ধতি’ প্রয়োগ করে পার্লামেন্ট। এছাড়া সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিগণ, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, CAG প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীগণকে পদচ্যুত করার প্রস্তাব পার্লামেন্টেই গৃহীত হয়।

(6) বিচার বিষয়ক ক্ষমতা : আইনসভার অবমাননা অথবা অধিকারভঙ্গের অভিযোগে পার্লামেন্ট সদস্য বা সদস্য নয় এমন যে কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে পারে। কোনো নিম্ন আদালতকে হাইকোর্টে উন্নীত করা, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে হাইকোর্ট স্থাপন করা বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের হাইকোর্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি কাজ ও পার্লামেন্টের এক্তিয়ারের অধীন।

আরও পড়ুন:  ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাসমূহ আলোচনা করো।

(7) সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা : নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয় ছাড়া পার্লামেন্ট অবশিষ্ট সমস্ত বিষয়ে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে রাজ্য বিধানসভাগুলিরও অনুমোদন প্রয়োজন হয়।

(8) জরুরী অবস্থার ঘোষণা : তিন ধরনের জরুরি অবস্থা যথা জাতীয় জরুরি অবস্থা, রাজ্যে সাংবিধানিক অচলাবস্থাজনিত জরুরি অবস্থা এবং আর্থিক জরুরি অবস্থার মধ্যে যে কোনো ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে তা পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে অনুমোদিত হতে হয়।

(9) জনমত গঠন : পার্লামেন্টে কোনো বিলের ওপর আলাপ আলোচনা, বিতর্ক প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণ সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। বিভিন্ন মন্ত্রী ও সদস্যদের প্রশ্নোত্তর-এর মাধ্যমে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায়।

(10) অন্যান্য ক্ষমতা : নতুন রাজ্যগঠন বা পুনর্গঠন, রাজ্য আইনসভার দ্বিতীয় কক্ষ গঠন বা বিলোপসাধন, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকারের অধীনে চাকুরীর শর্তাবলী নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

পরিশেষে বলা যায় ভারতের পার্লামেন্ট ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন। কিন্তু পার্লামেন্টের এইসব ক্ষমতা ও কার্যাবলী বাস্তবায়িত হয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার দ্বারা।

Leave a Comment