বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা কী? জাতীয় স্বার্থরক্ষার বিভিন্ন উপায়গুলি উল্লেখ করো ।

By

বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা :

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল–

(a) সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হল জাতীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা। কারণ দেশের স্বাধীনতা বজায় না থাকলে দেশটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে না। স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে সরকারকে সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হতে হয়। যেহেতু সব রাষ্ট্রের সমান আর্থিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতা থাকে না তাই রাষ্ট্রীয় সুস্থিতি রক্ষার জন্য বৃহৎ শক্তিশালী সম্পদশালী রাষ্ট্রগুলির সাহায্য নিতে হয়।

(b) প্রত্যেক দেশের প্রয়োজন জাতীয় উন্নয়নের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া। জাতীয় উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নকেও বোঝায়। উদ্বৃত্ত কাঁচামাল ও অন্যান্য দ্রব্য রপ্তানি ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানির মাধ্যমে দেশের উন্নতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন। ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও সঠিক কূটনীতি অনুসরণের মাধ্যমে একটি দেশ শিল্পোন্নত দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

(c) প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি বৈদেশিক নীতির যার প্রভাব পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন প্রভৃতির পরিবর্তে একটি সহবস্থান ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলা। কিন্তু শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি তাদের পুঁজি ও অর্থনীতি প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিরোধের পরিবেশ সৃষ্টি করে অস্ত্র বিক্রীসহ রাষ্ট্রগুলিকে তাদের পণ্য বিক্রীর বাজারে পরিণত করে। তাই অধিকাংশ উন্নয়নশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রগুলিকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে জাতীয় স্বার্থে তাদের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ সহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হয়।

আরও পড়ুন:  বিশ্বায়নের সংজ্ঞা লেখো। বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপ পর্যালোচনা করো।

(d) যদিও রাজনৈতিক মতাদর্শকে জাতীয় স্বার্থের উপাদান হিসাবে গণ্য করা নিয়ে মতবিরোধ আছে। তবু পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও সাম্যবাদী ধারণায় বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতি, কর্মসূচি প্রভৃতি ব্যাপারে ব্যাপক মত পার্থক্য দেখা যায়। এর ফলে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বৈদেশিক নীতি ও ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়।

(e) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের শক্তির প্রমাণ দিতে পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগ করে এবং তার ভয়াবহতা সমগ্র বিশ্বকে আতঙ্কিত করে। কিন্তু তারপরেই পৃথিবীর অসংখ্য দেশ একে একে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়ে পড়ে। তাই শক্তিধর রাষ্ট্র জাতীয় স্বার্থেই নিরস্ত্রীকরণ, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসারবোধ, মারণাস্ত্রের সংকোচনসহ যুদ্ধের উত্তেজনা প্রশমনে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের কথা বলেছে। কিন্তু কূটনৈতিক ধূর্ততা হিসাবে ওইসব বক্তব্য এর সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য যতক্ষণ না আন্তরিকভাবে সচেষ্ট ততদিন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলি বৃহৎ শক্তির প্রভাবে জাতীয় স্বার্থে ওইসব রাষ্ট্রগুলির নির্দেশে বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করবে।

আরও পড়ুন:  ভারতের অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা ব্যাখ্যা করো।

জাতীয় স্বার্থরক্ষার উপায়সমূহ –

(1) কুটনীতি : জাতীয় স্বার্থরক্ষার অন্যতম প্রধান উপায় হল কূটনৈতিক কার্যকলাপ। নিজের দেশের বিদেশনীতিকে কূটনীতিবিদরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সরকার এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলে ধরার কাজে সচেষ্ট থাকে। এ ব্যাপারে কূটনীতিকরা যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আপসরক্ষা, বিশ্বাসভাজন হওয়া এবং প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের ঘোষণা। তাই পামার ও পারকিনস্ কূটনীতিবিদদের গুরুত্বকে বোঝাতে তাঁদের নিজ নিজ দেশের ‘চক্ষু ও কর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

(2) প্রচার : জতীয় স্বার্থরক্ষার অন্যতম মাধ্যম প্রচার-কে হাতিয়ার করে একটি দেশ তার পররাষ্ট্রনীতির সপক্ষে অন্যান্য রাষ্ট্রের সরকার ও জনগণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম যথাঃ দূরদর্শন, বেতার, ইন্টারনেট, সংবাদপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে তা করা হয়ে থাকে। 

আরও পড়ুন:  বিশ্বউষ্ণায়নের প্রকৃতি আলোচনা করো।

(3) অর্থনৈতিক সাহায্য ও ঋণদান : জাতীয় স্বার্থরক্ষার উপায় হিসাবে উন্নত ও সম্পদশালী রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলিকে অর্থনৈতিক সহযোগ ও ঋণ প্রদান করে। বিনিময়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি সাহায্যগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলির অখণ্ড সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করে।

(4) জোট গঠন : সাধারণ স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুই বা অধিক রাষ্ট্রগুলি জোট গঠন করে থাকে। রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে জোট গঠিত হয়। তেমনি একটি রাষ্ট্রজোটের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে অন্য রাষ্ট্রজোটও গঠিত হয়।

(5) বলপ্রয়োগ : জাতীয় স্বার্থরক্ষার জন্য প্রয়োজনে রাষ্ট্রগুলি শক্তিপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন করে থাকে। বিশ্বের সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি তাদের জাতীয় স্বার্থ তথা বাণিজ্যিক স্বার্থকে বিস্তৃত করার জন্য অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। দরিদ্রদেশগুলির মধ্যে যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি করে সমরাস্ত্র বিক্রির পথ পরিষ্কার করে।

Leave a Comment