ভূমিকা : বর্তমানে ‘বিশ্বায়ন’কে কেন্দ্র করে সমগ্র পৃথিবীর অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজও সংস্কৃতি গভীরভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এতৎসত্ত্বেও বিশ্বায়নের একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভবপর হয়নি। জোফেস স্টিগলিৎস্ এর মতে, বিশ্বায়ন হল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগণের মধ্যে অত্যন্ত নিবিড়তর সংহতি-সাধন, যার ফলে পরিবহণ ও যোগাযোগের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং দ্রব্যসামগ্রী, পরিসেবা, পুঁজি, জ্ঞান ও মানুষের বিশ্বব্যাপী অবাধ যাতায়াত উন্মুক্ত ও সহজলভ্য হয়ে গেছে।
ডেভিড হেল্ড বিশ্বায়নকে ‘কার্যকলাপ, মিথস্ক্রিয়া ও ক্ষমতার আন্তর্মহাদেশীয় প্রবাহ ও নেটওয়ার্ক” বলে ব্যাখ্যা করেছেন। পিটার মারকাস-এর অভিমত হল, বিশ্বায়ন পুঁজিবাদের এমন এক ধরনের রূপ যা মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাদী সম্পর্কের সম্প্রসারণ ঘটায়। অতএব বিশ্বায়নকে এমন একটি বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়া বলে চিহ্নিত করা যায়, যাতে জাতিরাষ্ট্রের ধারণার অবসান ঘটিয়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত ও অবাধ আদান প্রদান চালানো সম্ভব হয়।
বিশ্বায়নের বিভিন্নরূপ : শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী সময় থেকে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে পুঁজির গমনাগমন হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রশক্তি কাঁচামাল ও উদ্বৃত্ত মূল্যের মুনাফা লাভের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পুঁজি রপ্তানি করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বিংশ শতকের সত্তর দশকের মধ্যকাল পর্যন্ত সময়কে “রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের যুগ” বলা যায়। তখন উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই শ্রমিক ও পুঁজির সম্পর্ক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। পরবর্তীতে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে আর্থিক সংকট দেখা দিলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটিয়ে অবাধ বাণিজ্যিক নীতি প্রচারিত ও প্রতিফলিত হয়। কারণ এর ফলে লগ্নি পুঁজির বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ ঘটিয়ে ব্যাপক মুনাফা অর্জন সম্ভব। এই নয়া সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শোষণমূলক দিকটিকে ‘বিশ্বায়ন’ নামে প্রচার করা হয়।
বিশ্বায়নে নিম্নলিখিত রূপগুলি হল :
(1) অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন : অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ধারণা বিশ্বের সমস্ত দেশের আর্থিক কর্মকাণ্ড পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অর্থনীতিবিদ অমিয়কুমার বাগচির ব্যাখ্যা অনুযায়ী বিশ্বায়ন হল- (a) বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে মানুষের অভিগমন ও নির্গমন (b) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিস্তৃতি (c) একদেশের পুঁজি অন্য দেশে বিনিয়োগ করে সেখানে শিল্পজাত দ্রব্য, কৃষিজপণ্য সহ পরিসেবামূলক পণ্য উৎপাদন করে সংশ্লিষ্ট। দেশ সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিক্রয়ের জন্য বাজার তৈরি করা (d) আন্তদেশীয় লগ্নি পুঁজির আদান প্রদান (e) বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে বাণিজ্যিক স্বাধীনতা দান (1) প্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সাহায্যে উৎপাদিত পণ্য তথা ভোগ্যপণ্যের প্রচার ও প্রভাব বিস্তার ইত্যাদি।
(2) রাজনৈতিক বিশ্বায়ন : বিশ্বায়ন জাতিরাষ্ট্রের ধারণার বিরোধিতা করে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের সর্বোচ্চ স্বার্থপূরণের জন্য দায়বদ্ধ থাকে এবং সর্বস্তরের শ্রমজীবি মানুষের স্বার্থে পুঁজির অবাধ মুনাফা তথা শোচনের ওপর নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু বিশ্বায়নের প্রবক্তরা আবার রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলোপ করে। ‘বিশ্বরাষ্ট্রব্যবস্থা’ ও চান না কারণ তাহলে শোষণ বঞ্ছনার দায়ভার তাদের ওপরে বর্তাবে এই আশঙ্কায়। সুতরাং বিশ্বায়ন বাধাবিহীন জাতিরাষ্ট্রের সমর্থক। যেখানে পুঁজিপতি শ্রেণীর সম্পত্তি ও একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকারের সুরক্ষায় রাষ্ট্রশক্তি দমনপীড়ন নীতি প্রয়োগ করতে পিছুপা হবে না। তাই বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও গুরুত্বকে হ্রাস করে স্বায়ত্তশাসনের নানাবিধ প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্টা। কারণ ক্ষুদ্র স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলি বৃহৎ পুঁজির নির্দেশে পরিচালিত হয়ে থাকে।
(3) সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন : সংস্কৃতির বিশ্বায়নের লক্ষ্য হল পৃথিবীব্যাপী একটি সমরূপ সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বর্তমানে সহজলভ্য ইন্টারনেট গণমাধ্যমের সাহায্যে আন্তর্জাতিক সর্বক্ষেত্রে অবাধ যাতায়াত সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে গেছে। জাতি রাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। স্বল্প ব্যয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির নানা দিক পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদির ফলে রাষ্ট্রীয় সনাতনী সাংস্কৃতিক ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। তৃতীয় বিশ্বের নিজস্ব সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে পড়েছে। পশ্চিমি ভোগবাদী সংস্কৃতি ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে।
যৌনতা ও মাফিয়াতন্ত্রের সঙ্গে হিংস্রতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যাপকভাবে। বিকৃত সংস্কৃতিকে আধুনিক সংস্কৃতি হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। শিশু, কিশোর ও যুবকরা এই সর্বনাশা বিকৃত সংস্কৃতির শিকার হচ্ছে। মানুষের প্রতিবাদী সুস্থ চেতনাকে এইভাবেই বিকৃত সংস্কৃতি ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।