বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের গ্রামীন বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত সুপারিশগুলি আলোচনা করো।

By

Procesta%20%2815%29

ভূমিকা : 1948 সালে 5ই নভেম্বর ভারত সরকার এর আদেশ মেনে 7 জন দেশিও এবং 3 জন বিদেশিও শিক্ষাবিদদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন বা রাধাকৃষ্ণান কমিশন গঠিত হয়।কমিশনটি রাধাকৃষ্ণান এর সভাপতিত্বে গঠিত হওয়ায় রধাকৃষ্ণান কমিশন নামেও পরিচিত। রাধাকৃষ্ণণ কমিশনের প্রতিবেদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য সুযোগ গড়ে তোলা। তৎকালীন ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে গ্রামের গুরুত্বকে বুঝে এই কমিশনে শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রাম্যজীবনের সাথে সমন্বয় সাধনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।তাই কমিশন গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় বা ‘Rural University’ গঠিত করার  সুপারিশ করে।

        গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনাটি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। যেমন – ডেনমার্কের জনতা কলেজ, গান্ধীজির বুনিয়াদী শিক্ষা, রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতন ও পল্লীসমাজ প্রভৃতি। 

(1) পল্লি উন্নয়ন : কমিশনটি লক্ষ করে যে , ভারতের প্রায় বেশিরভাগ মানুষই গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। অতএব তাদের সামাজিক উন্নতি ঘটানোর জন্য শুধুমত কিছু বৃত্তশীল শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের স্বার্থরক্ষা করলে চলবে না। বরং সবার আগে পল্লি উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দিয়ে গ্রামাঞ্চলগুলিকে বিজ্ঞান সম্মতভাবে পুনর্গঠিত করতে হবে।আর তার জন্য প্রয়োজনে গ্রামীণ অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার বিস্তারও করতে হবে। 

(2) কৃষি, জনশিক্ষা ও সমাজ উন্নয়ন : কমিশনের মতে, গ্রামীন বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলিতে কৃষি, উদ্যান রচনা, জনশিক্ষা, গ্রামোন্নয়ন কর্মসূচী, সমাজ উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়গুলি উপর বিশেষ ভাবে প্রাধান্য লাভ করবে। কমিশনের প্রতিবেদনে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ আছে গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি ও অন্যান্য বিষয়ের পরিকল্পনা গ্রহণের সময় গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের প্রয়োজনের দিকগুলি বা বিষয়গুলি বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে।

আরও পড়ুন:  সাধারণ মানসিক ও বিশেষ মানসিক ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য লেখো | বুদ্ধির সংজ্ঞা দাও

(3) গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থা : কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী বুনিয়াদি বিদ্যালয়গুলিকে গ্রামীণ বিদ্যালয় হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। প্রতিবেদনে এছাড়াও বলা হয়, কয়েকটি বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে একটি করে গ্রামীণ মহাবিদ্যালয় গড়ে উঠবে এবং কয়েকটি গ্রামীন মহাবিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে একটি গ্রামীন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে। 

গ্রামীন শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন স্তর : রাধাকৃষ্ণণ কমিশন, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণায় একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রামীণ শিক্ষা পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন। ওই শিক্ষা পরিকল্পনায় সাধারনত 4টি স্তরের কথা বলা হয়। সেগুলি হল—

  1.  নিম্ন ও উচ্চ বুনিয়াদি শিক্ষা – 7 অথবা 8 বছর।
  2.  উত্তর বুনিয়াদি বা মাধ্যমিক শিক্ষা – 3 অথবা 4 বছর।
  3.  গ্রামীণ মহাবিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষা – 3 বছর।
  4.  গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষা — 2 বছর।

(4) গ্রামীণ শিক্ষার পাঠ্যক্রম : কমিশনের মতে, গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলিতে প্রাথমিক,মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে কৃষিবিদ্যা চর্চার বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রাম্য জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমাজ উন্নয়ন,সংস্কৃতি, অর্থনীতির শিক্ষা প্রদান করতে হবে। এই শিক্ষা হবে পরিবেশ কেন্দ্রিক, উৎপাদন কেন্দ্রিক ও জীবন কেন্দ্রিক শিক্ষা। 

আরও পড়ুন:  শিখন ও পরিনমনের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করো | শিখন ও পরিনমনের মধ্যে সম্পর্ক কি?

(5) মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও আদর্শ গ্রাম গঠন : কমিশনে বুনিয়াদি অথবা মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলিকে আবাসিক করার সুপারিশ করা হয় এবং প্রতিটি বুনিয়াদি বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যাতে একটি আদর্শ গ্রাম গড়ে তোলা যায়, তার জন্য পরামর্শ দান করা হয়।

(6) তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক শিক্ষা ব্যবস্থা : উত্তর বুনিয়াদি পর্যায়ের শিক্ষা শেষ হলে গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামীণ মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্যক্রমে তত্ত্বগত বৌদ্ধিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি ব্যবহারিক জ্ঞানার্জনের সুযোগ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রামীণ শিল্প অর্থনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণামূলক কাজেরও সুযোগ সুবিধা থাকবে।

(7) বুনিয়াদী শিক্ষা : কমিশনের মতে, গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে গান্ধীজির বুনিয়াদী শিক্ষা। 

(8) কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়  পাঠ্যক্রম : কমিশনের মতে, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় এর পাঠ্যক্রমের প্রধান বিষয়গুলি হবে – দর্শন, ভাষা, সাহিত্য, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র, কৃষিবিজ্ঞান প্রভৃতি । এইসব পাঠ্যক্রম গ্রামীণ জীবনের পরিবেশ ও প্রয়োজন অনুযায়ী রচিত হবে। 

(9) নারিশিক্ষা : কমিশনের মতে, গ্রাম্য অঞ্চলে যেভাবে ছেলেরা শিক্ষাগ্রহণ করে সেই ভাবে মেয়েদেরও শিক্ষা ক্ষেত্রে সমসুযোগ দিতে হবে। গ্রামের মেয়ের যাতে গার্হাস্থ বিজ্ঞান, গার্হাস্থ অর্থনীতি, উদ্যান রচনা, গৃহ পরিচালনা ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ অর্তে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। 

আরও পড়ুন:  কোঠারি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য আলোচনা করো।

(10) কর্মসূচীর বিষয়ে সুপারিশ : কমিশন গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য যেসব কর্মসূচির বিষয়ে সুপারিশ করে, সেগুলি হল—

  • অনুমোদনের ব্যবস্থা : বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিতে অবস্থিত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলিকে অনুমোদন দানের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপায়ন : মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়গুলিকে আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
  • পাঠ্যক্রমে গ্রামীণ বিষয় সংযোজন : গ্রামীণ সমাজ সংস্কৃতি, শিল্প ও অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলিকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • গ্রাম্যজীবন সম্পর্কে গবেষণা : গ্রাম্য জীবনের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
  • তথ্য সংগ্রহ : গ্রাম্য জীবনের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করা।
উপসংহার : সর্বশেষে বলা যায় যে, রাধাকৃষ্ণান কমিশন গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত যেসব সুপারিশগুলি করেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চশিক্ষার বিস্তারের লক্ষ্য হিসাবে  রাধাকৃষ্ণান কমিশন গ্রাম জীবনের সাথে উচ্চশিক্ষাকে যুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, গ্রামীণ শিক্ষা ও সংস্কৃতির মান উন্নত করা, গ্রামীণ অর্থনীতিকে উন্নত করা, গ্রামীণ কৃষি শিল্প, বাণিজ্যিক ও পশুপালন উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামগুলিকে বিজ্ঞানসন্মত ভাবে নবগঠিত করা। 

Leave a Comment