বিচার বিভাগীয় সমীক্ষা বলতে কী বোঝ? বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা কীভাবে সংরক্ষিত হয় তা ব্যাখ্যা করো।

By

ভূমিকা : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারবিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লর্ড ব্রাইসের মতে “বিচার বিভাগের যথাযথ সমীক্ষার ওপরেই সরকারের উৎকর্ষতার বিচার হয়” নির্ভীক ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাফল্য।

বিচারবিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সরকারি আইন, আদেশ ও নির্দেশের বৈধতা বিচার করা। যেক্ষেত্রে দেখা যায় সংশ্লিষ্ট আইন, আদেশ বা নির্দেশের প্রকৃতি সংবিধান বিরোধী, সেক্ষেত্রে ওই আইন, আদেশ বা নির্দেশকে বিচারবিভাগ বাতিল ঘোষণা করতে পারে। আইন ও সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে বিচারবিভাগ সংবিধানের উদ্দেশ্য ও মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করে।

ল্যাস্কির মতে, বিচারকার্য পরিচালনার মধ্য দিয়ে বিচারবিভাগ একটি রাষ্ট্রের নৈতিক চরিত্র অনুধাবন করে। এছাড়া বিচারবিভাগ আইনি ন্যায়বিচার ছাড়াও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। অনেক সময় প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে বিচারকরা ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধি, সমকালীন স্বাভাবিক ন্যায়নীতির ওপর ভিত্তি করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। বিচারকদের এইসব সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে অনুরূপ কোনো মামলায় আইন হিসাবে পরিগণিত হয়। নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে বিচারবিভাগের ভূমিকা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। আইন ও শাসনবিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার রক্ষা করে বিচারবিভাগ।

বিচারবিভাগের স্বাধীনতা : বিচারবিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিম্নলিখিত বিষয়গুলির ওপর নির্ভরশীল—

(1) বিচারপতিদের যোগ্যতা : সৎ, সাহসী ও নিরপেক্ষ, আইনজ্ঞ বিচারপতি দৃঢ়তার সঙ্গে বিচারকার্য সম্পাদন করে থাকেন। দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কহীন ব্যক্তিরা যদি বিচারপতি পদে নিযুক্ত হন তাহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

আরও পড়ুন:  বিশ্বায়নের সংজ্ঞা লেখো। বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপ পর্যালোচনা করো।

(2) বিচারপতিদের নিয়োগ পদ্ধতি : বিচারপতিদের নিয়োগ পদ্ধতির ওপরেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। সাধারণত তিনটি পদ্ধতি অনুসারে বিচারপতিরা নিযুক্ত হয়ে থাকেন।

(i) জনগণ কর্তৃক নির্বাচন : অনেকের মতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিচারকগণ নির্বাচিত হয়ে আসার কথা বলেন। কিন্তু গার্নার, ল্যাঙ্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই পদ্ধতির সমালোচনা করে বলেছেন যে – (a) জনগণ তাৎক্ষণিক আবেগ ও দলীয় প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচন করতে পারেন (b) পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার আগ্রহে তাঁরা নৈতিকতা বিসর্জন দিতে পারেন। (c) জনপ্রিয় কোনো ব্যক্তিত্ব সুবিচারক হবেন এমন নিশ্চয়তা নেই। (d) নির্বাচনী ব্যবস্থার দ্বারা নির্বাচিত বিচারপতি কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থনপুষ্ট হলে তাঁর পক্ষে পক্ষপাতহীন বিচারকার্য অসম্ভব।

(ii) আইন বিভাগ কর্তৃক নির্বাচন : আইনসভার দ্বারা বিচারপতিদের নির্বাচনকে অনেকে গণতন্ত্র ও বিধিসম্মত বলে দাবী করেন। সুইৎজারল্যাণ্ড, বলিভিয়া, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশে এই পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে। কিন্তু অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই পদ্ধতিকে ত্রুটিপূর্ণ ও নিরপেক্ষতার পরিপন্থী বলে মনে করেন। তার কারণ হল – (a) এই পদ্ধতিতে আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মনোনীত প্রার্থীরাই বিচারক পদে নির্বাচিত হন। স্বভাবতই তাঁরা আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে থেকে পক্ষপাতমূলক বিচারকার্য সম্পাদন করতে পারেন। (b) আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যরা নিজ দলের সমর্থক কাউকে বিচারপতি হিসাবে নির্বাচিত করলে অনেক সময় যোগ্যতাসম্পন্ন বিচারপতিরা নির্বাচিত হতে পারেন না।

আরও পড়ুন:  ভারতের অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা ব্যাখ্যা করো।

(iii) শাসন বিভাগ কর্তৃক নির্বাচন : শাসন বিভাগের দ্বারা বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতিকে অনেকে অপেক্ষাকৃত ত্রুটিমুক্ত বলে মনে করেন। তবে এই পদ্ধতিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্ব্বোচ্চ শাসন কর্তৃপক্ষ প্রধান বিচারপতি বা বিচারপতিদের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। ল্যাঙ্কিও অনুরূপ মত প্রকাশ করে বলেছেন যে, শাসন বিভাগের প্রস্তাব বরিষ্ঠ বিচারপতিদের প্রতিনিধিদের গঠিত স্থায়ী কমিটির অনুমোদিত হওয়া প্রয়োজন। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরূপ পদ্ধতিতে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। তবে এই পদ্ধতিতেও যথেষ্ট নিরপেক্ষতা বজায় রাখা প্রয়োজন কারণ – (a) শাসনবিভাগের দ্বারা নিযুক্ত বিচারপতিরা অনেক সময় শাসনবিভাগের সপক্ষে বিচারকার্য সম্পাদন করে থাকেন। (b) অবসরের পর শাসন বিভাগীয় কোনো পদে ভবিষ্যতে নিযুক্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকলে নিরপেক্ষ ন্যায়বিচার অনেক সময় ব্যহত হয়।

বিচারপতির কার্যকাল : বিচারবিভাগের স্বাধীনতার অন্যতম শর্ত হল বিচারপতিদের কার্যকালের স্থায়িত্ব। বিচারপতিদের কার্যকালের স্থায়িত্ব যদি নির্দিষ্ট না থাকে বা স্বল্পকালীন হয় তাহলে তাঁদের দৃঢ়তার সঙ্গে ন্যায়বিচার করা সম্ভবপর হয় না। বিচারপতিরা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার প্রতিফলন তাঁদের বিচারকার্য করতে পারেন। কার্যকাল দীর্ঘ না হলে বিচারপতিরা দুর্নীতিপরায়ণও হতে পারেন। তাই বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রেই বিচারপতিদের কার্যকালের একটি নির্দিষ্ট বয়ঃসীমা নির্ধারিত আছে। 

আরও পড়ুন:  পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার অধ্যক্ষের ভূমিকার পর্যালোচনা করো।

বিচারপতিদের অপসারণ : আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ বা জনসাধারণ যদি খুব সহজেই বিচারপতিদের তাঁদের পদ থেকে অপসারণ করতে পারে তাহলে কোনো বিচারকের পক্ষেই নির্ভীক নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সম্পাদন সম্ভব নয়। তাই শুধু প্রমাণিত দুর্নীতি, অক্ষমতা, অযোগ্যতা ইত্যাদি গুরুতর কারনেই একটি বিশেষ সাংবিধানিক পদ্ধতির মাধ্যমেই বিচারপতিদের অপসারনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন

বিচারপতিদের বেতন, ভাতা : বিচারপতিদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা কম হলে তাঁদের দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বেতন, ভাতা ইত্যাদি যথেষ্ট না হলে অনেক যোগ্য আইনজীবী বিচারক পদে যোগ দিতে আগ্রহী হবেন না। সুযোগ্য বিচারপতি না থাকলে জটিল ও সংবিধান সম্পর্কিত মামলার সুমীমাংসা যথাযথ হয় না।

বিচারবিভাগের স্বতন্ত্রীকরণ : বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল বিচারবিভাগকে আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা। ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকর্তা হিসাবে বিচার বিভাগকে সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা প্রয়োজন। ল্যাস্কির মতে, স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখতে হলে বিচারবিভাগের স্বতন্ত্র অবস্থান অবশ্যই প্রয়োজন।

Leave a Comment