প্রশ্ন : বাংলা গানের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
উত্তর : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর হাত বাংলা গানের ধরা একটি নতুন রূপে আবির্ভাব হয়। তার গান গুলির মধ্যে সুর ও বাণীর আশ্চার্য এবং দুর্লভ সংগতিবিধান লক্ষ্য করা যায়। সুরের বৈচিত্র্য এবং বাণীর প্রায় সর্বত্রগামিতায় রবীন্দ্রসংগীত অপ্রতিদ্বন্দী। বাংলা গানের জগতে তার গানগুলি এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ ও ‘আমার সোনার বাংলা’ গানদুটি যথাক্রমে ভারত ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ নিজের গানকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। যেমন – ‘পূজা’, ‘প্রেম’, ‘স্বদেশ’, ‘প্রকৃতি’ প্রভৃতি । এছাড়াও সুর ও বাণীর দিক থেকে রবীন্দ্রসংগীতকে অন্যভাবে শ্রেণীবিভক্ত করা যায়। সুরের দিক থেকে রবীন্দ্রসংগীতকে 5 ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –
১) ধ্রুপদ ও ধামার : রবীন্দ্রনাথ হিন্দি গানের সুর নিয়ে ৭৭ টি ধ্রুপদ রচনা করেছেন এবং হিন্দি ধামার অনুসরণ করে মোট ১৪ টি গান তৈরি করেছেন। তার ধ্রুপদ গান গুলির মধ্যে দুটি বিখ্যাত গান হল – ‘প্রথম আদি তব শক্তি’ ও ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’।
২) খেয়াল ও ঠুংরি : উচ্চাঙ্গ সংগীত ব্যাবহার করে প্রায় তিনশো গান তৈরি করেন রবিদরনাথ ঠাকুর। এক্ষেত্রে হিন্দি খেয়াল ও ঠুংরির অনুসরণ করে কিছু গান তৈরি করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, খেয়াল দ্বারা সৃষ্ট গানের ক্ষেত্রে ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ এবং ঠুংরির ক্ষেত্রে ‘তুমি কিছু দিয়ে যাও’ গান দুটির নাম করা যায়।
৩) টপ্পা : হিন্দি টপ্পার অনুসরণে ১৪ টি এবং নিজস্ব শৈলীতে ২৫ টি টপ্পা গান রচনা করেছেন। হিন্দি ভাঙ্গা টপ্পা, যেমন, ‘হৃদয় বাসনা পূর্ণ হলো’ এর মতো গানে মধ্যমান।
৪) লোকসংগীত : রবীন্দ্রনাথের বহু গানেই বাংলার লোকসংগীতের ছায়া পড়েছে। তার লোকসংগীত গুলির মধ্যে বাউল, কীর্তনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তার লোকসংগীত গুলির মধ্যে ‘মেঘের কোলে কোলে’, ‘গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ’ প্রভৃতি গান উল্লেখযোগ্য।
৫) ভাঙ্গা গান : শুধু হিন্দি গানই নয়, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রাদেশিক সুর এবং পাশ্চাত্য সংগীত থেকেও অনুপ্রাণিত হয়ে বহু গান রচনা করেছেন। তিনি তার এই জাতীয় গানে ধ্রুপদ, ধামার, টপ্পা প্রভৃতি সুরের ব্যাবহার করেছেন। এই গানগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য গান হল – ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’।
অবদান : রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানে ‘সঞ্চারী’র প্রবর্তন করে, তথা ‘স্থায়ী’, ‘আভোগ’, ‘অন্তরা’ সুর বেধে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন প্রকার সুর ও তালের দ্বারা তৈরি করা দুর্লভ গান কবি স্বয়ং প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ প্রভৃতি বিভিন্ন পর্যায়ে বিষয়গতভাবে বিভক্ত করেছেন। তার গান গুলির মধ্যে ধ্রুপদ-খামার, খেয়াল-ঠুংরি-টপ্পা, লোকসংগীত প্রভৃতি সুর নিহত রয়েছে। তার গান গুলির মধ্যে এইগুলির পাশাপাশি হাস্যরসাত্ব, স্বদেশবোধ, প্রেম, ঋতু প্রভৃতি ধারা তার সংগীতে রয়েছে।
সৃষ্ট গান সমূহ : তার দ্বারা বিভিন্ন প্রকার এর সুর ও তালের দ্বারা সৃষ্ট দুর্লভ গান গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘ওরে ফাগুন লেগেছে বনে বনে’, ‘আমার সকল রসের ধারা’, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’, ‘সেদিন আমায় বলেছিলে’, ‘এস এস বসন্ত ধরাতলে’, ‘আলো আমার আলো গো’ প্রভৃতি।
উপসংহার : সর্বশেষে বলা যায় যে, বাংলা সংগীতের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের অবদান অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথের গান রুচিশীল বাঙালির সুখ ও দুখের চিরন্তন আশ্রয় ছিল। রবীন্দ্রনাথ দ্বারা রচিত গান গুলির মধ্যে আনুমানিক প্রায় ২২৩২ টি গান সংকলিত হয়েছে ‘গীতবিতানে’। আবার, তার গানের মধ্যে ১৯৩১ টি গানের স্বরলিপি নিজেই তৈরি করেছেন স্বরবিতানে। তিনি বাংলা গান নিয়ে সারাজীবন ধরে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যার ফলস্বরূপ আজ তা সমৃদ্ধির শিখরে উত্তীর্ণ হয়েছে। তিনি ঝম্পক, ষষ্ঠী, একাদশী এর মতো নতুন বহু তলের সৃষ্টিকর্তা। রবীন্দ্রনাথ তার সংগীত এর মাধ্যমে বাঙালির অগৌরব ও অপ্রাপ্তিকে মিটিয়ে দিতে চেয়েছেন।
◪ তৎকালীন রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক দুজন বিশিষ্ট গীতকারের নাম হল – দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও রজনীকান্ত সেন।