পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার অধ্যক্ষের ভূমিকা :
কেন্দ্রীয় আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভার স্পীকারের ন্যায় রাজ্য বিধানসভার স্পীকার বা অধ্যক্ষ বিধানসভা পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বিধানসভার মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব অধ্যক্ষের উপরে ন্যস্ত।
নির্বাচনের পর রাজ্য বিধানসভার প্রথম অধিবেশনে সভার সদস্যরা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে অধ্যক্ষ হিসাবে ও একজনকে উপাধ্যক্ষ বা ডেপুটি স্পীকার হিসাবে নির্বাচিত করেন। বিধানসভা পরিচালনা ও কোন বিলের পক্ষে ভোটাভুটির সময় তিনি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন। তবে কোন বিলের পক্ষে-বিপক্ষে সম সংখ্যক ভোট পড়লে অধ্যক্ষ একটি ‘নির্ণায়ক ভোট দিয়ে বিষয়টির ফয়সালা করেন। বিধানসভার স্বাভাবিক মেয়াদের মতো স্পীকারের কার্যকালের মেয়াদও পাঁচ বছর। তবে তিনি পদত্যাগ করলে, মৃত্যু হলে বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যগণ কর্তৃক পদচ্যুত হলে স্পীকারের পদ শূন্য হয়।
ক্ষমতা ও কার্যাবলী : পশ্চিমবঙ্গও ভারতের একটি অন্যতম অঙ্গরাজ্য। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ২৯৪ জন। বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে সর্বসম্মতিক্রমে অধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়ে থাকেন।পশ্চিমবঙ্গ তথা রাজ্যবিধানসভাগুলির অধ্যক্ষের ক্ষমতার উৎস হল ভারতের সংবিধানে রাজতালিকায় অন্তর্ভুক্ত বিধানসভার কার্যপরিচালনা সংক্রান্ত বিধি। এছাড়া তাৎক্ষণিক কিছু অলিখিত ক্ষমতাও তাঁর আছে। অধ্যক্ষের উল্লেখযোগ্য ক্ষমতাগুলি হল—
(1) সভাপরিচালনা : সুশৃঙ্খলভাবে সভাপরিচালনা করা অধ্যক্ষের দায়িত্ব। বিধানসভায় কোন বিষয়গুলি উত্থাপন করা হবে, কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসার জন্য অনুমতি দেওয়া হবে, কোন নোটিশ আলোচনার জন্য গ্রহণ করা হবে ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন অধ্যক্ষ। পরিস্থিতি সাপেক্ষে বিধানসভার কার্যপরিচালনা সংক্রান্ত নিয়মকানুন ক ব্যখ্যা করেন অধ্যক্ষ। সভার আলোচনা শুরু করার অনুমতি অধ্যক্ষ যেমন প্রদান করেন পাশাপশি আলোচনা বন্ধের প্রস্তাব গ্রহণের বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। অধ্যক্ষ তাঁর কোন সিদ্ধান্ত পূনর্বিবেচনা করবেন কিনা তা একান্তই তাঁর ইচ্ছাধীন। অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তকে আদালতের এক্তিয়ারের বাইরে রাখা হয়েছে।
(2) শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা : সভার দৃষ্টি আকর্ষণসহ সভায় ভাষণ দিতে হলে সব সদস্যকেই সভার অনুমতি নিতে হয়। সদস্যদের বক্তব্য রাখার ক্রমতালিকা অধ্যক্ষই স্থির করেন। সদস্যরা যাতে সুশৃঙ্খল আচরণ করেন এবং সংসদীয় ভাষায় বক্তব্য পেশ করেন অধ্যক্ষ সেদিকে লক্ষ্য রাখেন। বিধানসভার ভিতরে অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তই চু ড়ান্ত তাই তাঁর নির্দেশ সবাই মেনে চলেন। সভায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তিনি সংশ্লিষ্ট সদস্যদিগকে কক্ষ ত্যাগের নির্দেশ দিতে পারেন, মৃদু ভৎসনা করতে পারেন প্রয়োজনে মার্শাল দিয়ে বল প্রয়োগের মাধ্যমে সভার বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারেন। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে গেলে অধ্যক্ষ সভার কার্য সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করতে পারেন।
(3) সদস্যদের অধিকার রক্ষা : বিধানসভার সদস্য বা সদস্য নন যে কেউ অধিকার ভঙ্গ করলে তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। সভার সদস্যদের বিশেষ অধিকারসমূহ রক্ষার দায়িত্ব অধ্যক্ষের।
(4) অর্থবিল সংক্রান্ত ক্ষমতা : কোনো বিল অর্থবিল কিনা সে বিষয়ে অধ্যক্ষের সিদ্ধাত্ম ন্তই চূড়ান্ত। অর্থবিলকে চিহ্নিত করার জন্য তিনি সার্টিফিকেট প্রদান করেন।
(5) যোগাযোগের মাধ্যম : রাজ্যপাল ও বিধানসভার মধ্যে যোগযোগের মাধ্যম হলেন অধ্যক্ষ। রাজ্যপাল প্রেরিত বানী, বার্তা ইত্যাদি বিধানসভায় পেশ করেন অধ্যক্ষ। তৎসহ বিধানসভার কার্যাবলী রাজ্যপালকে তিনি জ্ঞাত করেন।
(6) ‘কোরাম’ পর্যবেক্ষন : বিধানসভায় ‘কোরাম’ বা নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য অনুপস্থিত থাকলে তিনি সভার কাজ বন্ধ রাখতে পারেন। সভার মোট সদস্যের এক-দশমাংশের উপস্থিতিতে ‘কোরাম’ হয়।
(7) কমিটি সংক্রান্ত ক্ষমতা : বিধানসভার বিভিন্ন কমিটি গঠনের দায়িত্ব স্পীকারের। কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের তিনিই নিয়োগ করেন। কমিটিগুলি তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীনেই কাজ করে।
(৪) পদত্যাগপত্রের সত্যতা বিচার সহ সদস্যপদ বাতিলের ক্ষমতা : বিধানসভার কোন সদস্য তাঁর কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করলে সেই পদত্যাগপত্র স্বইচ্ছায় করা কিনা তা তদন্ত করে দেখার দায়িত্ব অধ্যক্ষের। অনুসন্ধানের পরে তিনি নিশ্চিত হলেই পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করেন। এছাড়া বিধানসভার কোন সদস্য দলত্যাগ-বিরোধী আইন অনুযায়ী সদস্যপদ রাখার যোগ্যতা হারালে তিনি সেই সদস্যের সদস্যপদ বাতিল ঘোষণা করতে পারেন।
(9) অন্যান্য ক্ষমতা : অন্যান্য ক্ষমতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
- কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সদস্যদের জ্ঞাত করার জন্য অধ্যক্ষ সভায় আলোচনা করেন।
- অধিবেশনের কার্যক্রম দেখার জন্য তিনি সাংবাদিক ও দর্শকদের গ্যালারিতে বসার অনুমতি প্রদান করেন।
- সভার কার্যবিবরণী তাঁর তত্ত্বাবধানেই সংরক্ষিত হয়।
- এছাড়া দলত্যাগ বিরোধী আইনে কোন সদস্যের সদস্যপদ বাতিলের ক্ষমতা অধ্যক্ষের আছে। পদত্যাগে ইচ্ছুক সদস্যকে অধ্যক্ষের কাছেই পদত্যাগ পত্র জমা দিতে হয় এবং তিনি তার সত্যতা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় রাজ্যবিধানসভার অধ্যক্ষ সংসদীয় গণতন্ত্রের একজন নিরপেক্ষ সঞ্চালক। বিধানসভার অভ্যন্তরে তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সরকারি ও বিরোধীপক্ষ উভয়পক্ষের সদস্যদের প্রতি তাঁর সমদৃষ্টি ও সমান সুযোগ দেওয়া অধ্যক্ষের মর্যাদার অনুপন্থী।