পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
উনিশ শতকের একজন প্রবাদপ্রতিম পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সমাজসংস্কার, শিক্ষাবিস্তার, পাণ্ডিত্য, দয়াপরায়ণতা এবং তেজস্বিতায় তিনি সমকালীন যুগের অনন্য ব্যক্তিত্ব। বাংলার সমাজসংস্কার ও সাহিত্যসংস্কারে তাঁর অবদান অপরিসীম।
‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিখ্যাত ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা ভগবতী দেবী। অন্য অনেকের মতো গ্রামের পাঠশালাতেই তাঁর বিদ্যারম্ভ। একটু বড়ো হলে তাঁর পিতা তাঁকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় আসার সময়ই তাঁর পিতা বিদ্যাসাগরের অসাধারণ মেধার পরিচয় পান রাস্তায় মাইলস্টোন গণনার ঘটনায়। কলকাতায় এসে পিতা তাঁকে সংস্কৃত কলেজে ভরতি করে দেন। সংস্কৃত কলেজে প্রায় বারো বছর পড়াশোনা করে তিনি সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি-সহ বহু ভাষা শেখেন ও অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এরই পাশাপাশি ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর পরিসীমাহীন পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়ে সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিতগণ তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষর পদ অলংকৃত করেন। অধ্যক্ষ থাকাকালীন সংস্কৃত কলেজে অব্রাহ্মণ ছাত্রদের প্রবেশাধিকারকে স্বীকৃতি দেন।
বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর অন্যতম মাইলস্টোন। তিনি বহু গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদ করেছেন। ‘বাসুদেব চরিত’, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘শকুন্তলা, ‘সীতার বনবাস’, ভ্রান্তিবিলাস’ ইত্যাদি তাঁর অনুবাদমূলক রচনা। এগুলি অনুবাদ গ্রন্থ হলেও এতে অনুকরণ নয়, লেখকের মৌলিক প্রতিভারই পরিচয় পরিস্ফুট। ছোটোদের জন্য তিনি ‘বোধোদয়’, ‘কথামালা’, ‘আখ্যানমঞ্জুরী’ ইত্যাদি রচনা করেন। তিনি ছদ্মনামে ‘অতি অল্প হইল’, ‘আবার অতি অল্প হইল’-সহ বহু ব্যঙ্গমূলক রচনা লেখেন। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষাকে সহজসরল, সাবলীল, সকলের পাঠ-উপযোগী করে তোলেন। বাংলা গদ্যে প্রথম দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন ইত্যাদি যতিচিহ্নের যথাযথ ব্যবহারে বাক্যকে অর্থপূর্ণ করে তোলার কৃতিত্বও তাঁরই প্রাপ্য।
পণ্ডিত বিদ্যাসাগর ছিলেন দৃঢ়চেতা, আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন, যুক্তিবাদী, ব্যক্তিত্ববান পুরুষ। তিনি নিজে যেটি ঠিক বলে মনে করতেন সেই সংকল্প থেকে তাঁকে নড়ানোর কোনো ক্ষমতা কারোর ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তাঁর পিতা তাকে যেদিন স্নান করতে বলতেন সেদিন তিনি কিছুতেই স্নান করতেন না, পরিষ্কার বস্ত্র পরে তাঁকে স্কুলে যেতে বলা হলে তিনি অপরিষ্কার কাপড় পরতেন। এই জেদ পরবর্তীকালে তাঁর সমাজসংস্কারমূলক কাজে লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে মাতা ভগবতী দেবীর কাছ থেকে তিনি অপরিসীম দয়া ও নারী জাতিকে শ্রদ্ধা করার মহৎ গুণ পেয়েছিলেন। তিনি নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও করুণাতেই শাস্ত্র থেকে প্রমাণাদি গ্রহণ করে কৌলীন্য প্রথার বিরোধিতা করেন, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রদ করেন এবং বিধবাবিবাহ প্রচলন করেন। নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য তিনি বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল (বেথুন স্কুল) স্থাপন করেন। এই সমস্ত সমাজসংস্কারমূলক কাজে তিনি যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করেন সেগুলি ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিৎ কিনা এতবিষয়ক প্রস্তাব’, ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিৎ কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ ইত্যাদি পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ করে রাখেন।
উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার, সাহিত্য সংস্কারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান অবশ্যস্বীকার্য। কালের যাত্রাপথে এই মহান ব্যক্তি দ্বিশতবর্ষে পদার্পণ করেছেন। সমগ্র দেশ সেই উদ্যাপনে উন্মুখ। যদিও প্রশ্ন জাগে বর্তমান সমাজ তাঁকে কতটা জানল, কতটা বুঝল। বাংলার ‘দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই পরলোকগমন করেন।