সপক্ষে যুক্তি :
(1) সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন :– অনেক সময় সাময়িক উত্তেজনা বা জনমতের চাপে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা জাতীয় স্বার্থবিরোধী আইন তৈরি করতে পারে। কিন্তু দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় উভয় কক্ষে আলাপ আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে জনস্বার্থে সুচিন্তিত আইন তৈরির সম্ভাবনা থাকে।
(2) নিম্নকক্ষের স্বৈরাচারিতা বোধঃ- লর্ড অ্যাকটন আইনসভার দ্বিতীয় কক্ষকে ব্যক্তিস্বাধীনতার নিরাপত্তার পক্ষে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় স্বৈরাচারী আইন প্রণীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আইনসভার সমক্ষমতাসম্পন্ন দুটি কক্ষ থাকলে একে অপরের স্বৈরাচারিতা রোধ করে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করতে পারে।
(3) জনমতের প্রতিফলন :- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দুটি কক্ষের নির্বাচন পৃথক পৃথক সময়ে হয় বলে প্রবহমান জনমতের সুষ্ঠু প্রতিফলন আইনসভায় লক্ষ করা যায়। তাই জনমতের সুষ্ঠু প্রতিফলনের জন্য দ্বিতীয় কক্ষের প্রয়োজন।
( 4 ) যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় আবশ্যিক :- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় আঞ্চলিক স্বার্থের যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে তা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পক্ষে বিশেষ উপযোগী বলে মনে করা হয়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার নিম্নকক্ষে নির্বাচিত সদস্যরা জাতীয় স্বার্থ এবং উচ্চকক্ষে মনোনীত সদস্যরা আঞ্চলিক স্বার্থে কাজ করতে পারেন। তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পক্ষে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অপরিহার্য বলে মনে করা হয়।
(5) রাজনৈতিক শিক্ষা :- এইরূপ আইনসভার দুটি কক্ষে আলাপ-আলোচনা তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে আইন প্রণীত হয়ে থাকে। আইন সভার দুটি কক্ষেই ভিন্নমতাদর্শী দলের সদস্যদের মধ্যে আইন প্রণয়নের সময় তর্ক বাদানুবাদ চলে থাকে, নানারকম যুক্তি পাল্টা যুক্তির উপস্থাপনা হয়ে থাকে। এইসব কার্যক্রম দুরদর্শনের মাধ্যমে সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। এর ফলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে।
(6) সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা :- সংখ্যালঘুদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব আইনসভায় না থাকলে গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। সেক্ষেত্রে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পরোক্ষ নির্বাচন বা মনোনয়নের মাধ্যমে সংখ্যালঘু প্রতিনিধি পাঠানো যায়। সংখ্যালঘু প্রতিনিধিরা আইনসভায় নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নে ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। দ্যুগুই-এর অভিমত হল, শ্রেষ্ঠ আইনসভার নিদর্শন হল এককক্ষে জনপ্রতিনিধিত্ব অন্যকক্ষে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব।
(7) জ্ঞানীগুণি ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব :- অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের উপস্থিতি আইনসভার উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে। গুণী, শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ অনেক সময় প্রত্যক্ষ নির্বাচনের সমস্যার ও শ্রমের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্বিতা করেন না। তাই আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে উচ্চকক্ষে এই সব জ্ঞানী-গুণীদের মনোনীত করা সম্ভবপর হয়।
(৪) সমাজতন্ত্রবাদীদের বক্তব্য :- সমাজতন্ত্রবাদীদের মতে, বহু জাতিসমন্বিত রাষ্ট্রে প্রতিটি গোষ্ঠী যাতে স্বীয় স্বীয় জাতীয় বৈশিষ্ট্য, ভাষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারে সেজন্যই দ্বিতীয় কক্ষের প্রয়োজন।
বিপক্ষে যুক্তি : –
(1) অগণতান্ত্রিক গঠন:- গণতন্ত্র যেহেতু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নিয়ে জনগণের জন্য শাসন, তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইনসভা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নিয়েই গঠিত হওয়া প্রয়োজন। এই দৃষ্টিকোন থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভাকে অগণতান্ত্রিক বলা যেতে পারে।
(2) অনাবশ্যক :- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় উভয় কক্ষেই যদি একই রাজনৈতিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে নিম্নকক্ষে পাশ হওয়া আইনের গুণাগুণ বিচার না করেই উচ্চকক্ষে তা গৃহীত হয়ে যায়। অন্যদিকে দুটি কক্ষই যদি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয় দুই কক্ষে যদি ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয় তাহলে তীব্র মতবিরোধের ফলে আচলাবস্থা দেখা দেবে, ফলে জনস্বার্থ ব্যহত হবে। এ প্রসঙ্গে আবেসিয়ে বলেছেন, “দ্বিতীয় কক্ষ যদি প্রথম কক্ষের সঙ্গে একমত হয়, তবে তা অনাবশ্যক’; আর যদি ভিন্নমত পোষন করে, তবে তা ক্ষতিকর।
( 3 ) যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষে অপরিহার্য নয় :- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার পক্ষে আবশ্যিক নয়। সংবিধানের মাধ্যমেই কেন্দ্র ও রাজ্যসরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা যায়। ল্যাঙ্কির মতে, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যেই অঙ্গরাজ্যগুলির স্বার্থ সুরক্ষিত আছে।
(4) জ্ঞানীগুণিরা উপেক্ষিত থাকে :- গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাই নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে। তাই দ্বিতীয় কক্ষে সদস্য মনোনয়ন বা নির্বাচনে দলীয় রাজনীতিই প্রাধান্য বিস্তার করে। নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মনোনীত প্রার্থীরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কক্ষের সদস্যপদ লাভ করেন। তাই অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত উপযুক্ত জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা দ্বিতীয় কক্ষের সদস্য হতে পারেন না।
(5) সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংশয় :- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা আছে এমন রাষ্ট্রগুলির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় দ্বিতীয় কক্ষের ক্ষমতা ও এক্তিয়ার প্রথম কক্ষের থেকে কম। অর্থবিলের ব্যাপারে দ্বিতীয় কক্ষের মতামতের কোনো মূল্য নেই।
(6) সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষায় আবশ্যিক নয় :- সংবিধানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ সঠিকভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারে। তাই সংখ্যালঘু স্বার্থ সুরক্ষায় দ্বিতীয় কক্ষের প্রয়োজন নেই বলেই অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
(7) ব্যয়বহুল :- আইনসভার দুটি কক্ষ থাকলে উচ্চকক্ষের গঠন, নিয়ন্ত্রণ, পরিষেবা ও সদস্যদের নির্বাচন প্রক্রিয়া, বেতন ভাতা ইত্যাদির জন্য বিপুল পরিমাণে অর্থ ব্যয় হয়। তাই এত ব্যয়বহুল দ্বিতীয় কক্ষের অপ্রয়োজনীয়তার পক্ষেই অনেকে মত প্রকাশ করেছেন।