জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো। জাতীয় স্বার্থরক্ষার বিভিন্ন উপায় উল্লেখ করো।

By

প্রশ্ন : জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো। জাতীয় স্বার্থরক্ষার বিভিন্ন উপায় উল্লেখ করো।

উত্তর : আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম মৌলিক ধারণা হল জাতীয় স্বার্থ। সর্বপ্রকার জাতীয় মূল্যবোধের সমষ্টিকেই জাতীয় স্বার্থ বলা যায়। মরগেনথাউ ক্ষমতালাভ ও জাতীয় স্বার্থকে পরিপূরক বা অভিন্ন বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আবার অন্যান্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বহু ও বিভিন্ন ধরনের বিষয়ীগত মতামত ও চিন্তাভাবনার মধ্যে দ্বন্দ্বের রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশের মধ্যেও জাতীয়স্বার্থের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। জাতীয় স্বার্থের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হিসাবে বলা যায়—জাতীয় স্বার্থ বলতে “জাতির সেইসব ন্যূনতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহকে বোঝায়, যেগুলি রূপায়ণের জন্য রাষ্ট্রগুলি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।” যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জাতীয় নিরাপত্তা ও উন্নয়ন এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

জাতীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়। তবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পররাষ্ট্রনীতির পার্থক্য লক্ষ করা যায়। সেইসব ক্ষেত্রে কূটনৈতিক বা বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ওইসব জাতীয় স্বার্থ ও সুরক্ষা বজায় রেখে একটি সহমতে পৌঁছতে চেষ্টা করে। তবে তা করার সময় সরকারকে সর্বতোভাবে জাতির ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা, জাতীয় উন্নয়ন, ঐতিহ্য ইত্যাদির দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হয়। ফ্র্যাঙ্কেলের মতে, জাতীয় স্বার্থ হল পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মুখ্য ধারণা। জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় মূল্যবোধের ধারণা পরিপূরক।

আরও পড়ুন:  বিশ্বউষ্ণায়নের প্রকৃতি আলোচনা করো।

রাষ্ট্রগুলির সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতির অন্যতম শর্ত হল শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা। সেজন্য প্রতিটি রাষ্ট্রকেই এমন বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করা উচিত যাতে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক হিংসা, আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টার পরিবর্তে একটি সমন্বয়মূলক শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়।

টমাস রবিনসনের মতে জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতি নিম্নলিখিতভাবে উল্লেখ করা যায়।

(i) মুখ্য জাতীয় স্বার্থ : যেসব স্বার্থ সংরক্ষণ প্রতিটি জাতির ক্ষেত্রে আবশ্যক। যেমন প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতির সংরক্ষণ।

(ii) গৌণ জাতীয় স্বার্থ : গৌণ জাতীয় স্বার্থ বলতে বোঝায় যেসব জাতীয় স্বার্থ জাতির অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে আবশ্যক না হলেও তা সংরক্ষণ করা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। যেমন অনাবাসী নাগরিকদের স্বার্থ সুরক্ষা, ইত্যাদি।

(iii) স্থায়ী ও জাতীয় স্বার্থ : রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি অপরিবর্তনীয় স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থ হিসাবে উল্লেখ করা যায়।

(iv) পরিবর্তনশীল জাতীয় স্বার্থ : পরিবর্তনীয় জাতীয় স্বার্থ বলতে বোঝায় কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে একটি জাতির যেসব স্বার্থ জাতীয় উন্নয়নের পক্ষে বিশেষ কার্যকরী সেইসব স্বার্থকে।

আরও পড়ুন:  ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো।

(v) সাধারণ জাতীয় স্বার্থ : সাধারণ জাতীয় স্বার্থের প্রধান উদাহরণ হল নিরস্ত্রীকরণ বা আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা।

(vi) সুনির্দিষ্ট জাতীয় স্বার্থ : এইরূপ জাতীয় স্বাথের উদাহরণ হিসাবে বলা যায় একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দ্বারা তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

জাতীয় স্বার্থরক্ষার উপায়সমূহ :

(1) কুটনীতি : জাতীয় স্বার্থরক্ষার অন্যতম প্রধান উপায় হল কূটনৈতিক কার্যকলাপ। নিজের দেশের বিদেশনীতিকে কূটনীতিবিদরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সরকার এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলে ধরার কাজে সচেষ্ট থাকে। এ ব্যাপারে কূটনীতিকরা যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আপসরক্ষা, বিশ্বাসভাজন হওয়া এবং প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের ঘোষণা। তাই পামার ও পারকিনস্ কূটনীতিবিদদের গুরুত্বকে বোঝাতে তাঁদের নিজ নিজ দেশের ‘চক্ষু ও কর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

(2) প্রচার : জতীয় স্বার্থরক্ষার অন্যতম মাধ্যম প্রচার-কে হাতিয়ার করে একটি দেশ তার পররাষ্ট্রনীতির সপক্ষে অন্যান্য রাষ্ট্রের সরকার ও জনগণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম যথাঃ দূরদর্শন, বেতার, ইন্টারনেট, সংবাদপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে তা করা হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন:  বিশ্বায়নের সংজ্ঞা লেখো। বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপ পর্যালোচনা করো।

(3) অর্থনৈতিক সাহায্য ও ঋণদান : জাতীয় স্বার্থরক্ষার উপায় হিসাবে উন্নত ও সম্পদশালী রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলিকে অর্থনৈতিক সহযোগ ও ঋণ প্রদান করে। বিনিময়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি সাহায্যগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলির অখণ্ড সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করে।

(4) জোট গঠন : সাধারণ স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুই বা অধিক রাষ্ট্রগুলি জোট গঠন করে থাকে। রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে জোট গঠিত হয়। তেমনি একটি রাষ্ট্রজোটের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে অন্য রাষ্ট্রজোটও গঠিত হয়।

(5) বলপ্রয়োগ : জাতীয় স্বার্থরক্ষার জন্য প্রয়োজনে রাষ্ট্রগুলি শক্তিপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন করে থাকে। বিশ্বের সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি তাদের জাতীয় স্বার্থ তথা বাণিজ্যিক স্বার্থকে বিস্তৃত করার জন্য অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। দরিদ্রদেশগুলির মধ্যে যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি করে সমরাস্ত্র বিক্রির পথ পরিষ্কার করে।

Leave a Comment