জয়দেব ও গীতগোবিন্দ সম্পর্কে টীকা :
‘গীতগোবিন্দের রচয়িতা কবি জয়দেব খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতকের শেষার্ধে বাংলার বীরভূম জেলার কেন্দুবিল্ব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জয়দেব ছিলেন বৈয়ব সাধক। রাজা লক্ষ্মনসেনের রাজসভায় জয়দেব ছিলেন সভাকবি। তাঁর পিতার নাম ছিল ভোজদেব এবং মাতা বামাদেবী। তাঁর পত্নীর নাম ছিল পদ্মাবতী। সংস্কৃত সাহিত্যে ভক্তিমূলক একটি গীতিকাব্য হলো জয়দেবের গীতগোবিন্দম্’। রাধাকৃষ্ণের লীলা বর্ণনাতেই কবি জয়দেব প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। গীতগোবিন্দের মতো কান্তমধুরকোমল পদাবলি সমগ্র সংস্কৃতসাহিত্যে নয়, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে এর তুলনা মেলা ভার। ভাবের বিচিত্রতায়, পদলালিত্যে, অলঙ্কার মাধুর্যে এই গীতিকাব্যটি এক অভূতপূর্ব আনন্দের সঞ্চার করে।
দ্বাদশ সর্গে সমাপ্ত ‘গীতগোবিন্দের বিষয়বস্তু রাধাকৃষ্ণের বসন্তকালীন প্ৰণয়লীলা। রাধাকৃষ্ণের প্রেমের চিরন্তন রূপলীলাই এই কাব্যের উপজীব্য। ‘ভাগবত’-এর দ্বাদশ স্কন্ধের অনুসরণে ১২টি সর্গবিশিষ্ট চতুর্বিংশ অষ্টাপদীতে কবি জয়দেব আলোচ্য গীতিকাব্যটি রচনা করেন। এই কাব্যে ৮০টি শ্লোকও ২৪টি গীতের সমাবেশ পরিলক্ষিত হয়।
প্রথম সর্গে রাধার কৃষ্ণবিরহের স্মৃতিছবি বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে বসন্তের রাসলীলার চিত্রও অঙ্কিত হয়েছে।
দ্বিতীয় সর্গে বর্ণিত হয়েছে রাধাকৃষ্ণের পারস্পরিক বিরহ ও মিলনের প্রতিচ্ছবি।
তৃতীয় সর্গে বর্ণিত হয়েছে ‘কৃষ্ণ রাধার জন্য চিন্তান্বিত’-এর প্রতিচ্ছবি। চতুর্থ সর্গে রাধার সখীর মাধ্যমে কৃষ্ণের কাছে রাধার মানসিক অবস্থার কথা নিবেদিত হয়েছে
পঞ্চম সর্গে বর্ণিত হয়েছে- অভিসারিকা রাধার জন্য কৃষ্ণের প্রতীক্ষা।
ষষ্ঠ সর্গে চিত্রিত হয়েছে- কৃষ্ণের কাছে রাধার সংকেত পাঠানো। সপ্তম সর্গে পরিলক্ষিত হয় কৃষ্ণের অদর্শনে রাধার বিরহ চিত্র।
অষ্টম সর্গে বর্ণিত হয়েছে রাধার অভিমান।
নবম সর্গে চিত্রিত কৃষ্ণের রাধার মান ভাঙানোর চিত্র।
দশম বা একাদশ সর্গে চিত্রিত হয়েছে উভয়ের মিলন সম্ভাবনার আনন্দঘন চিত্রের সমাবেশ। দ্বাদশ সর্গে রাধাকৃষ্ণের মিলন বিলাস বর্ণিত হয়েছে।
এই ললিত মধুর কাব্যটির বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণি নির্ণয় বিষয়ে পণ্ডিতগণ নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কোনো কোনো পণ্ডিত গীতগোবিন্দের মধ্যে বৈয়বীয় দর্শনতত্ত্বের সন্ধান পেয়েছেন। বৈয়ব সাধাকগণ গীতগোবিন্দকে দার্শনিক মহাকাব্য বলে মনে করেন। গীতগোবিন্দের প্রতিটি সর্গে কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। বিভিন্ন রাগের মাত্রাবৃত্তে রচিত পদাবলি বা গান আছে। গীতগোবিন্দের আঙ্গিক অনেকটা কাব্যেরই মতো, বিশেষত গীতিকাব্য বা Lyric ধর্মী। জনপ্রিয় কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে শৃঙ্গাররস সমন্বিত ‘গীতগোবিন্দ’ কবি রচনা করেন। রাধাকৃষ্ণের অপ্রকৃত প্রেমলীলার রূপচ্ছবি কবি আত্মগত অনুভবের দ্বারা সুন্দর সুষমায় বর্ণনা করেছেন—এটিকে ‘গীতিকাব্য’ বলাই সঙ্গত। বিশ্বসাহিত্যে ভাষার সৌষ্ঠবে, লালিত্যে, মাধুর্যে গীতগোবিন্দের মতো গীতিকাব্য বিরল।