গান্ধীজির সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত ধারনাটি আলোচনা করো।

By

গান্ধীজির সত্যাগ্রহ : ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে গান্ধীজি যে ব্রিদোহ ঘোষণা করেছিলেন সেই রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি পদ্ধতি হিসাবেই ‘সত্যাগ্রহ’ পরিচিত লাভ করেছে। গান্ধীজির মতে, সত্যাগ্রহ আইন হল ‘ভালোবাসার আইন’ এবং এরূপ আইন হল ‘একটি শাশ্বত নীতি’। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত সব ক্ষেত্রেই এই নীতি কার্যকর হয়।

গান্ধীজির এই সত্যাগ্রহের উপলব্ধি এসেছিল বাইবেল, উপনিষদও শ্রীমদ্ভাগবত গীতা থেকে। এসেছিল চৈতন্য মহাপ্রভু ও মীরাবাই, বুদ্ধদেব ও মহাবীর এবং হজরত মহম্মদের চিন্তাভাবনা ও তাঁদের জীবনের নানা কার্যকলাপ থেকে। মনীষী থোরো এবং টলস্টয় এর রচনাবলী থেকেও তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। এভাবেই তিনি সত্যাগ্রহের ধারণাটি গড়ে তুলেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেই আন্দোলনের একটি যথার্থ নামকরণের আগ্রহে তিনি বিভিন্ন নামের মধ্যে থেকে ‘সত্যাগ্রহ’ নামটিকেই গ্রহণ করেছিলেন।

প্রধানত সত্য ও অহিংসার ওপর ভিত্তি করেই গান্ধীজির সত্যাগ্রহ তত্ত্বটি গড়ে উঠেছে। সর্বপ্রকার ত্যাগস্বীকার ও দুঃখবরণ করে সর্বশক্তি দিয়ে অন্যায়কে অস্বীকার করাই হল সত্যাগ্রহের মূল কথা। গান্ধীজি সত্যাগ্রহীকে অধৈর্য হতে নিষেধ করেছেন। কারণ অধৈর্য হলে হিংসা আসতে পারে। তাঁর মতে প্রতিপক্ষের মনে ন্যায়বোধ জাগিয়ে তুলে তার হৃদয় জয় করাই হল সত্যাগ্রহের মূলকথা।

গান্ধীজি সত্যাগ্রহের তিনটি দিকের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন :

(1) সত্য : গান্ধীজি সত্যকেই ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করতেন এবং সেই সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য অহিংসা নীতির কথা বলেছিলেন।

আরও পড়ুন:  উদারনীতিবাদ কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

(2) অহিংসা : গান্ধীজির রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হল অহিংসা। সত্যের সন্ধান করতে গিয়েই তিনি অংহিংসার সন্ধান পান। অহিংসার গণভিত্তি তৈরি হয়েছিল সত্যাগ্রহের মাধ্যমে। তাঁর মতে একজন সত্যাগ্রহী সবসময় হিংসাকে পরিত্যাগ করে চলবে। একজন সত্যাগ্রহী সত্য তথা ঈশ্বর লাভের জন্য হিংসা পরিত্যাগ করে চলবেন।

(3) আত্মনিগ্রহ : গান্ধীজির মতে আত্মপীড়নই হল তপস্যা। আত্মনিগ্রহের মধ্য দিয়েই সাহস সঞ্চয় করতে হবে। কারণ আত্মনিগ্রহের মাধ্যমেই সত্যাগ্রহী প্রতিপক্ষের হৃদয় জয় করতে পারবেন। তাই আত্মনিগ্রহ ও হিংসাকে গান্ধীজি পরস্পর বিরোধী বলে মনে করতেন।

সত্যাগ্রহের বিভিন্ন রূপ : গান্ধীজি সত্যাগ্রহের জন্য সত্যাগ্রহীকে দুঃখবরণ করতে এমন কি প্রয়োজনে মৃত্যুবরণ করার জন্যও প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। সত্যাগ্রহী প্রতিপক্ষকে অবিশ্বাস করবে না এবং সত্যাগ্রহ চলাকালীন কোনো রকম উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করবেনা।

(1) অসহযোগ : অসহযোগ আন্দোলনকে গান্ধীজি একটি শক্তিশালী ও সঠিক পথ হিসাবে গ্রহন করেছিলেন। তাঁর মতে, অসহযোগ দৈহিক প্রতিরোধ বা হিংসার থেকেও অনেক বেশি সক্রিয়। গান্ধীজির মতে জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্মতির ওপর যে কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থাটিকে থাকে। জনসাধারণ সম্মতি প্রত্যাহার করলে রাষ্ট্রের পক্ষে কার্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন:  ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা বিশ্লেষণ করো।

(2) আইন অমান্য : সত্যাগ্রহীরা স্বইচ্ছায় রাষ্ট্রীয় আইন মান্য করে চলে। কিন্তু যদি কোনো অনৈতিক আইন প্রয়োগ করা হয় তাহলে তাকে অমান্য করার অধিকার সত্যাগ্রহীদের রয়েছে। গান্ধীজি আইন অমান্যকে আক্রমণাত্মক ও আত্মরক্ষামূলক এই দু-ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন নিজের অধিকার রক্ষার জন্য আক্রমণাত্মক আইন অমান্য করা আর মনুষ্যত্ব বিরোধী খারাপ আইনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক আইন অমান্য করার কথা বলেছেন।

(3) অনশন : গান্ধীজি সত্যাগ্রহের জন্য সর্বশেষ পদ্ধতি হিসাবে ‘অনশনকে বেছে নিয়েছেন। অনশনের ইতিবাচক দিক হিসাবে তিনি বলেছেন যে, অনশন হল একটি আত্মিক কর্মোদ্যোগ এবং ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। যার প্রভাব জাতীয় জনজীবনে গভীর রেখাপাত করবে।

(4) পিকেটিং : সত্যাগ্রহের অন্যান্য পথের মতো এই দিকটিও হবে অহিংস। পিকেটিং–এর ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রনী ভূমিকা নেওয়ার জন্য গান্ধীজি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

(5) অন্যান্য পদ্ধতি : এছাড়া গান্ধীজি পারস্পরিক আলাপ আলোচনা, আবেদন নিবেদন, সক্রিয় প্রচারমূলক সভা সমিতি ও মিছিল প্রভৃতি পদ্ধতি গ্রহণের কথাও বলেছেন। গান্ধীজি সত্যাগ্রহীদের জন্য কিছু আচরণ বিধির কথাও বলেছেন। যথা— সত্যাগ্রহী কখোনো ক্রোধ প্রকাশ করবেন না। সত্যাগ্রহের সময় রাষ্ট্রশক্তির প্রহার সহ্য করতে হবে। আইন অমান্যকালে গ্রেপ্তার বরণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রভৃতি। বন্দী অবস্থায় আইন অমান্যকারী জেলের কর্মচারীদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করবেন। জেলের মধ্যে সমস্ত কয়েদিদের সঙ্গে নিজের পার্থক্য বোধ রাখা চলবে না প্রভৃতি।

আরও পড়ুন:  ভারতের লোক আদালতের গঠন ও কার্যাবলী সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করো।

এছাড়া সত্যাগ্রহীকে ব্যক্তিগত সুবিধা অসুবিধা অগ্রাহ্য করে দলনেতার নির্দেশ পালন করতে হবে। দলের মধ্যে থাকাকালীন সর্বদা দলের নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় সত্যাগ্রহী কোনোভাবেই কোনো বিরোধের মধ্যে থাকবেন না। কিন্তু যে পক্ষ ন্যায়ের পথে থাকবে সেইপক্ষকে সাহায্য করবেন। নিজেকে ধর্মীয় পরিচিতির উর্দ্ধে রেখে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ মীমাংসায় সহযোগিতা করবেন।

উপসংহার : গান্ধীজির সত্যাগ্রহ তত্ত্বটিকে নানাভাবে সমালোচনা করা হয়। অনেকে এই সত্যাগ্রহকে মানুষের মধ্যে অবাস্তব এক বিভ্রান্তির পরিস্থিতির কারণ বলে বর্ণনা করেছেন। এতদ্‌সত্ত্বে ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। গান্ধীজির নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যদের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ও আইন অমান্য আন্দোলন গন আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছিল।

Leave a Comment