প্রশ্ন: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিগুলি বিশ্লেষণ করো।
উত্তর: বর্তমানে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করার জন্য প্রধান তিনটি বিভাগ রয়েছে। এগুলি হল- আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগ। আইনবিভাগ যে আইন তৈরি করে শাসনবিভাগ সেই আইন প্রয়োগ করে। অন্যদিকে বিচার বিভাগ আইন বিভাগ দ্বারা তৈরি আইনের দ্বারা বিচারকার্য সম্পাদন করে থাকে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুযায়ী সরকারের এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজ করবে না; এক বিভাগ অন্য বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করবে না এবং একই ব্যক্তি একাধিক বিভাগের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত থাকবে না।
পক্ষে যুক্তি :
(1) তিন বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ পৃথকভাবে কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকে। ফলে এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না এবং তিন বিভাগের নিজস্ব স্বাধীনতা বজায় থাকে।
(2) কার্যকারিতা বৃদ্ধি : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে সরকারের মুখ্য তিনটি বিভাগ (আইন, শাসন ও বিচার) সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ পায় এবং কাজের উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়।
(3) স্বৈরাচারিতা রোধ : স্বৈরাচারী প্রবণতারোধে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি অত্যন্ত কার্যকরী। কারণ আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাধ্যবাধকতায় স্বৈরাচারি হয়ে উঠতে পারে না।
(4) দায়িত্ব : সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে সুস্পষ্ট দায়িত্ব বন্টন করা থাকে এই নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে। ফলে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগও বিচার বিভাগ স্বীয় স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে সম্যক সচেতন থাকে।
(5) রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত : মন্তে ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের আবশ্যিকতার কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া, জন লক্ ও হ্যারিংটন প্রমুখও ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন।
বিপক্ষে যুক্তি :
(1) বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব নয় : সমালোচকদের মতে, এই নীতিটির বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব নয়। বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির সরকারের প্রধান তিনটি বিভাগ (আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ) পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই সরকার পরিচালনা করে। সংসদীয় বা রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার দুটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপরিচালনায় এক বিভাগ অন্য বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রভাব বিস্তার করে এবং ব্যক্তি বিশেষ একাধিক বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। যেমন ভারতে মন্ত্রীসভার সদস্যরা আইনসভার সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পরেই দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শাসনবিভাগের প্রধান রাষ্ট্রপতি বিচারপতিদের নিয়োগ করে থাকেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ভিটো প্রয়োগ করে সাময়িকভাবে আইনসভা প্রণীত আইন বাতিল করে দিতে পারেন। বর্তমানে দলব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে সরকার পরিচালিত হওয়ার ফলে আইন ও শাসনবিভাগের নৈকট্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
(2) বাস্তবায়ন সম্ভব নয় : জন স্টুয়ার্ট মিল, রুন্টলি, ফাইনার ল্যাঙ্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, এই নীতিটির বাস্তব প্রয়োগ কাম্য নয়। কারণ নীতিটি বাস্তবায়িত হলে বিভিন্ন বিভাগেরমধ্যে বিবাদ দেখা দেবে। ল্যাস্কির মতে, তিনটি বিভাগ যদি সম্পূর্ণ আলাদাভাবে কাজ করে তাহলে প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্বশীলতা বিনষ্ট হবে। বিভাগগুলির স্বতন্ত্র অবস্থান বিরোধ সৃষ্টি করবে, ফলে জনস্বার্থ ব্যাহত হবে।
(3) প্রয়োগের কুফল : ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরন নীতিটি বাস্তবায়িত হলে অনেক বৈষম্য দেখা দিতে পারে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শাসন ও আইনবিভাগ থেকে মুক্ত রাখার জন্য কিছু রাজ্যের বিচারকগণ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে জয়লাভের জন্য বিচারপতি রাজনৈতিক দলগুলির সাহায্যপ্রার্থী হন। তাই নির্বাচিত বিচারপতিদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ ও সংশয় দেখা দিতে পারে।
(4) ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ নয় : স্যাবাইন, গিলক্রিস্ট প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতিটিকে স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষাকবচ হিসাবে মনে করেন না। কারণ আইন বিভাগ স্বৈরাচারী আইন প্রনয়ন করলে শাসনবিভাগ সেই আইন প্রয়োগ করতে বাধ্য থাকে এবং বিচারবিভাগ ও স্বৈরাচারী আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করবে। তাই ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণনীতি কখনো ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ হতে পারে না। ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ হল সদাসতর্ক জনগণ।
(5) জৈব মতবাদীদের সমালোচনা : জৈব মতবাদীদের মতে, সরকারকে একটি জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করে বলা যায় যে জীবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি যেমন পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ করতে পারে না, তেমনি সরকারের বিভাগগুলি কখনোই পরস্পরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ করতে পারে না।
(6) সব বিভাগ সমক্ষমতাসম্পন্ন নয় : ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরননীতি অনুযায়ী সরকারের মুখ্য তিনটি বিভাগ সমক্ষমতাসম্পন্ন। কিছু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে দেখা যায় ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে শাসনবিভাগ সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। আবার, তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোন থেকে আইন বিভাগের কৌলিন্য বেশি কারণ আইনি বিভাগ প্রণীত আইনই শাসন ও বিচারবিভাগের প্রয়োগ ও বিচারের ক্ষেত্র।
(7) মার্কসবাদী মতামত : মার্কসবাদীদের মতে, যেকোন সরকার মাত্রই একটি বিশেষ তথা পুঁজিবাদী শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় তৎপর। অতএব বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ অর্থহীন। সরকারের প্রত্যেকটি বিভাগই পৃথকভাবে শোষক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় পূর্ণ ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ কাম্য না হলেও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আংশিক ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ তথা বিচারবিভাগের স্বাধীণতা রক্ষা করা প্রয়োজন। গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য বিচারবিভাগকে আবশ্যই শাসনবিভাগের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাখা প্রয়োজন।