ভূমিকা : প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার মধ্যবর্তী স্তর হল মাধ্যমিক শিক্ষা। শিক্ষার্থীর জীবন বিকাশের দিক থেকে সমগ্র কৈশোর কাল হল এই শিক্ষা স্তরের অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, প্রাথমিক শিক্ষাস্তর এবং উচ্চশিক্ষা স্তরের মধ্যবর্তী যে শিক্ষা বিদ্যালয়ে পরিচালিত হয় তাই হল মাধ্যমিক শিক্ষা। কোঠারি কমিশনের মতে, মাধ্যমিক শিক্ষা হল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত যে শিক্ষাকাল তাই হল মধ্যমমিক শিক্ষার স্তর।
কোঠারি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য :
(1) দৈহিক বিকাশ : সুস্থ সবল দেহ, সুস্থ সবল মনের আধার। আবার সুস্থ সবল মন প্রাণশক্তির অন্যতম উৎস হয়ে জীবকে চালনা করে। তাই সুস্থভাবে বাঁচতে গেলে দৈহিক বিকাশ একান্ত প্রয়োজন। দৈহিক বিকাশ যথাযথ না হলে বৌদ্ধিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা দেখা যায়। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল দৈহিক বিকাশ ঘটানো।
(2) নৈতিক বিকাশ : সামাজিক রীতিনীতি, বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও মূল্যবোধ প্রভৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান না থাকলে সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে চলা কঠিন। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল নৈতিক শিক্ষা।
(3) প্রাক্ষোভিক বিকাশ : দুঃখ, আনন্দ, উল্লাস প্রভৃতি প্রক্ষোভগুলির যথাযথ বিকাশ না – ঘটলে জীবনে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হল প্রাক্ষোভিক বিকাশ।
(4) আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ : ভাববাদী বা দার্শনিকদের মতে জরা ও ব্যাধিগ্রস্ত এ পৃথিবী থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে চাই আধ্যাত্মিক চেতনা। ওই আধ্যাত্মিক চেতনাই মানুষকে আসৎ কর্ম থেকে বিরত রাখে, মুক্তির পথ প্রশস্ত করে। এই মাধ্যমিক শিক্ষার আরেকটি লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ।
(5) সামাজিক গুনাবলির বিকাশ : মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজে তার জন্ম ও সমাজের মধ্যেই তার মনুষ্যত্বের বিকাশ। তাই সামাজিক গুণাবলির বিকাশ না ঘটলে সমাজ তথা জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।
(6) বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বিকাশ : বর্তমান যুগ হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। আজ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটানো প্রয়োজন। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল বাস্তবভিত্তিক বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিকাশ ঘটানো।
(7) সুনাগরিক তৈরি : নাগরিকই হল দেশের বড়ো সম্পদ। এই সম্পদের সর্বাঙ্গীন বিকাশ প্রয়োজন। তাই শিক্ষার লক্ষ্য হল সুনাগরিক তৈরি করে সুস্থ সবল জাতি গঠন করা।
(৪) প্রগতিশীল সমাজচেতনা : আধুনিক জগৎ দুরন্তগতিতে চলমান। তাই সমাজের প্রগতিশীলতা সম্বন্ধে সচেতন না হলে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে। অভিযোজনের ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি হয়। সুতরাং মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রগতিশীল সমাজ চেতনার বিকাশ ঘটানো ৷
(9) নেতৃত্বদানের ক্ষমতার বিকাশ : দেশের উন্নতি নির্ভর করে সঠিক নেতৃত্বদানের ওপর। বলিষ্ঠ নেতৃত্ব জনগনের স্বপ্ন পূরণ করতে সক্ষম হয়। যথার্থ নেতৃত্ব ছাড়া দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হল নেতৃত্বদানের ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো ।
(10) পরিবেশদূষণ সম্বন্ধে চেতনার জাগরণ : বর্তমানে পরিবেশ দূষণ এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখতে হবে, দূষিত পরিবেশ অসংখ্য রোগ সৃষ্টির কারণ। তাই রোগ ভোগ থেকে মুক্তির জন্য, দেহ মনের সুস্থতার জন্য চাই দূষণ মুক্ত পরিবেশ। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল পরিবেশ দূষণ সম্বন্ধে চেতনার জাগরণ ঘটানো।
(11) জাতীয়তাবোধের জাগরণ : বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে দ্বন্দ্ব, প্রতি রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব পরিবেশকে খারাপ করে তুলেছে। বেঁচে থাকার অধিকারকে বহুলাংশে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তাই জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। সুতরাং মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল কিশোর-কিশোরীদের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করা।
(12) আন্তর্জাতিকতাবোধের জাগরণ : স্বদেশ প্রীতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব প্রীতির জাগরণ ঘটানো জরুরি। আজ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে দ্বন্দ্ব বিশ্বশান্তিকে বিঘ্নিত করেছে। বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের বিশাক ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জনজাগরণের প্রয়োজন। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্তর্জাতিক বোধের বিকাশ ঘটানো।
উপরিক্ত অংশে আলোচিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলি ছাড়াও উৎপাদনমুখী শিক্ষা, ভাষার বিকাশ, শিক্ষায় সমসুযোগ প্রভৃতি মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার : সর্বশেষে বলা যায় যে, মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোঠারি কমিশনের গুরুত্ব অপরিসীম। কোঠারি কমিশন সর্বপ্রথম সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কমিশনের মতে নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষাকে মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর বলে উল্লেখ করা হয়। কোঠারি কমিশনের মাধ্যমিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল – শিক্ষায় সমসুযোগ, সুনাগরিক তৈরি, শিক্ষার্থীদের ব্যাক্তি সত্বর বিকাশ, নেতৃত্ব বোধএর বিকাশ প্রভৃতি।