প্রশ্ন : কার্ল মার্কস-এর ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বটি আলোচনা করো।
উত্তর : মার্কবাদের অন্যতম মৌলিক উপাদান ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অর্থ হল মানুষের বিকাশ এবং মানবসমাজ ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিকাশের ইতিহাসে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগ। সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস আলোচনা করা হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। জীবন ধারণের জন্য মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক পরিচ্ছদ সহ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা স্বাভাবিক। তাই উৎপাদনের উপায় ও উৎপাদন পদ্ধতির ওপর সমাজের বৈষয়িক জীবনযাত্রা নির্ভরশীল। মানব ইতিহাস পর্যালোচনা করে মার্কস প্রমাণ করেছেন যে, মানুষের আবশ্যিক উৎপাদন পদ্ধতির প্রভাবে মানবসমাজের মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সমাজের মূল ভিত হল অর্থনীতি এবং আইন, ধর্ম ও সাহিত্য প্রভৃতি দাঁড়িয়ে থাকে সেই ভিতের ওপরে।
উৎপাদনের দুটি দিক তথা উপাদান হল দুটি যথা- প্রকৃতি এবং শ্রমশক্তি। উৎপাদনের অর্থ হল মানুষের সামাজিক উৎপাদন। উৎপাদন পদ্ধতির ও দুটি দিক আছে যথা উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদন শক্তি বলতে বোঝায় শ্রমিক ও তার শ্রমক্ষমতা, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। আর উৎপাদন সম্পর্ক বলতে বোঝায় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রেণিতে শ্রেণিতে উৎপাদনভিত্তিক পারস্পরিক সম্পর্ককে।
সমাজের পরিবর্তনের কারণ: মার্কসের মতে উৎপাদনকার্যের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে সংগতি বজায় থাকার ফলে। কিন্তু ধারাবাহিক বিকাশের ফলে উৎপাদন শক্তির অগ্রগতি দেখা দিলে উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সংগতি নষ্ট হয় এবং এর ফলে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
উৎপাদনের বৈশিষ্ট্যসমূহ :
উৎপাদনের প্রথম বৈশিষ্ট্য হল গতিশীলতার উৎপাদন কখনো অনেককাল একজায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে না। স্তালিনের মতে, বাস্তবভিত্তিক ঐতিহাসিক চর্চায় উৎপাদনের নিয়ম, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের নিয়ম ও সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশের নিয়মগুলির বিশ্লেষণ করা এবং প্রচার করা।
উৎপাদনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল উৎপাদন শক্তির সক্রিয়তা ও বৈপ্লবিক গতি। মার্কসের মতানুযায়ী, অগ্রগতির একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে সমাজে বস্তুত উৎপাদন শক্তির সঙ্গে প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের বিরোধ দেখা দেয়। বিরোধের শুরুতে উৎপাদন সম্পর্ক বিকশিত উৎপাদন শক্তির কিছু অংশকে সাময়িকভাবে ধ্বংস করে নিজের প্রাধান্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়। ক্রমে উৎপাদন সম্পর্কের গুণগত বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। ফলে উৎপাদন উন্নততর পর্যায়ে উন্নীত হয়।
উৎপাদনের তৃতীয় পর্যায় বা বৈশিষ্ট্য হল পুরাতন উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎপাদন শক্তির বিকাশ ঘটে এবং উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। তবে সমাজ বিবর্তনের কোনো স্তরেই উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন বিনা সংঘর্ষে ঘটে না। প্রতি স্তরেই শ্রেনিদ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই অগ্রগতি সাধিত হয়। এইভাবেই আদিম সমভোগবাদী সমাজ থেকে দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ ও পুঁজিবাদী-সমাজের উৎপত্তি, বিকাশ ও পরিবর্তন সাধিত হয়েছেন এভাবেই মার্কস ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে বৈজ্ঞানিক পন্থায় সমাজ বিবর্তনের ধারাকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।