এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও ।

By

ভূমিকা : আইনসভার গঠন এককক্ষবিশিষ্ট না দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হওয়া উচিত তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। আবেসিয়ে, বেন্থাম, ল্যাস্কি, ফ্রাংকলিন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সপক্ষে মত দিয়েছেন।

সপক্ষে যুক্তি :

(1) গণতান্ত্রিক : আইনসভা জনগণের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই গঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ গণতন্ত্র হল জনগণের দ্বারা জনগণের শাসন। প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত আইনসভার প্রতিটি কার্যকলাপ আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক ইত্যাদির উপর নির্বাচকদের আগ্রহ ও দৃষ্টি থাকে বলে আইনসভা সর্বদা জনস্বার্থ রক্ষাকেই প্রাধান্য দেয়।

(2) দায়িত্ব নির্ধারণ সহজ : আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট হলে সেই আইনসভা নিজ কার্যাবলী সম্পর্কে দায়িত্ব সচেতন হয়। এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও তাঁদের দায়িত্ব পালনে আন্তরিক থাকেন।

(3) দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ : এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় জরুরী বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় না। দীর্ঘসূত্রতার ফলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

( 4 ) ব্যয়বহুল নয় : এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা শুধুমাত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়েই গঠিত হয়। অন্যদিকে আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে সাধারণত নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা মোর্চার নেতৃস্থানীয়রাই উচ্চকক্ষে মনোনীত হন। ফলে একই দলের সদস্যরাই দুটি কক্ষে থাকায় নিম্নকক্ষের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের বিরোধিতা করেন না। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা থাকলে সদস্যদের বেতন, ভাতা, রক্ষণাবেক্ষণ নানাবিধ কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়িত হয়। তাই এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ব্যয়বহুল নয়।

আরও পড়ুন:  ভারতের লোক আদালতের গঠন ও কার্যাবলী সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করো।

(5) যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অনুপন্থী : দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাফল্যের অন্যতম শর্ত বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সুস্পষ্ট ক্ষমতা বণ্টনের ফলে রাজ্যগুলির স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। ল্যাস্কি বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত চরিত্রের মধ্যেই অঙ্গরাজ্যগুলির স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।

(6) সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন : দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন সম্ভব হয়— এই ধারণা সঠিক নয়। কারণ একটি বিলকে আইনে রূপান্তরিত করতে গেলে কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করে আসতে হয়। প্রতিটি পর্যায়ে বিলটিকে যথাযথভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। বিলের ওপর আলোচনা, বিতর্ক প্রচারমাধ্যমের মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে প্রকাশ পায় এবং বিলের পক্ষে বিপক্ষে জনমত সংগঠিত হয়। ফলে জনমতের দিকে ভারসাম্য রেখেই একটি বিল আইনে পরিণত হয়। এভাবেই এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সুচিন্তিত আইন প্রণীত হতে পারে।

(7) এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভাই কাম্য : এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রবক্তাদের মতে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দুটি কক্ষে একই রাজনৈতিক দল বা জোটের সদস্যদের গরিষ্ঠতা থাকলে নিম্নকক্ষ জনস্বার্থবিরোধী কোনো আইন পাশ করলেও উচ্চকক্ষ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী নিম্নকক্ষের প্রণীত আইনকেই সমর্থন জানায়। আবার সমক্ষমতাসম্পন্ন দুটি কক্ষ থাকলে এবং দুটি পরস্পরবিরোধী দলের গরিষ্ঠতা থাকলে তীব্র মতবিরোধের ফলে আইনপ্রণয়নের ক্ষেত্রে অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে, ফলে জনস্বার্থ ব্যাহত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আবেসিয়ের মন্তব্য, “দ্বিতীয় কক্ষ যদি প্রথম কক্ষের সঙ্গে একমত হয়। তাহলে তা অনাব্যশক; আর যদি দ্বিমত পোষণ করে, তবে তা ক্ষতিকারক।” এইসব নানাবিধ কারণে এককক্ষ বিশিষ্ট আত্ম ইনসভাই কাম্য বলে মনে করা হয়।

আরও পড়ুন:  মার্কস-এর রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বটি আলোচনা করো।

বিপক্ষে যুক্তি : এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভাকে নানা দিক থেকে সমালোচনা করে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয় সেগুলি হল—

(1) স্বৈরাচারী আইন প্রণয়ন : একক্ষকবিশিষ্ট আইনসভা থাকলে একটিমাত্র কক্ষই আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী হয়। ফলে উচ্চকক্ষ না থাকায় নিজেদের ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করতে পারে যা ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী ও দলীয় স্বার্থের অনুপন্থী হতে পারে, যা অগণতান্ত্রিক।

(2) সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন অসম্ভব : সুচিন্তিত ও জনকল্যাণমুখী আইন প্রণয়নে এককক্ষবিশিষট আইনসভা কার্যকরী নয়। অনেক সময় দলীয় স্বার্থ, ভাবাবেগ ও উত্তেজনা কিংবা তাৎক্ষণিক জনমতের চাপে জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী অবিবেচনা প্রসূত আইন প্রণীত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে লেকির অভিমত হল। দ্বিতীয় কক্ষের উপস্থিতি সংযতকারী, নিয়ন্ত্রণমূলক ও পুণবিবেচনার ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

(3) পরিবর্তনশীল জনমতের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীনতা : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত সর্বদা পরিবর্তনশীল সেক্ষেত্রে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় সদস্যরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (৪ কিংবা ৫ বছর) নির্বাচিত হয়ে থাকেন। ফলে নির্বাচন পরবর্তী জনমতের কোনো প্রতিক্রিয়া এইরূপ আইনসভায় প্রত্যক্ষ করা যায় না। এই জন্য পরিবর্তিত জনমতের সঙ্গে সাযুজ্য রাখার জন্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রয়োজন।

আরও পড়ুন:  ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো।

(4) সংখ্যালঘু স্বার্থের পরিপন্থী : এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার নির্বাচন প্রত্যক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয় বলে অনেক সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি আইনসভায় নির্বাচিত হতে পারেন না। ফলে আইনসভায় তাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব না থাকলে তাদের দাবিদাওয়াজনিত স্বার্থের পক্ষে জানাবার সুযোগ থাকে না।

(5) সুষ্ঠুভাবে কার্য সম্পাদনে প্রতিবন্ধকতা : জনকল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি অনেক বর্ধিত হয়েছে। নাগরিক পরিসেবার দায়িত্ব ও পরিধিত সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের আইনসভার কাজও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ব্যতীত নানাবিধ বিষয়ে আইন প্রণয়ন ও জনকল্যাণমুখী নীতির বাস্তবায়ন অসম্ভব।

(6) যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পক্ষে উপযোগী নয় : যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মধ্যে। সেক্ষেত্রে আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট হলে আঞ্চলিক স্বার্থ যথাযথ গুরুত্ব পায় না। তাই যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্র-রাজ্যের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভাই কাম্য।

(7) সমাজতন্ত্রবাদীদের অভিমত : সমাজতন্ত্রের সমর্থকেরা মনে করেন একটি রাষ্ট্রে বসবাসকারী বহু জাতির অবস্থান – যাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রয়েছে। এই নানাভাষা নানা মতাবলম্বী জাতিসমূহের যথাযথ প্রতিনিধিত্বের জন্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রয়োজন। রাষ্ট্রের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষেই তাঁরা যুক্তি দেন।

Leave a Comment