ভূমিকা : এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী উদারনীতিবাদ হল এমন একটি ধারণা, যা সরকারের কার্যপদ্ধতি ও নীতি হিসাবে ব্যক্তি ও সমাজের গ্রহণীয় আদর্শ হিসাবে স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে। উদারনীতিবাদ হল এমন একটি স্বাধীন জীবনের কণ্ঠ স্বর; যা ব্যক্তির চিন্তা, বিশ্বাস, মতপ্রকাশ সর্বত্রই সর্বাধিক পরিমাণ স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ায়। সংকীর্ণ অর্থে উদারনীতিবাদ বলতে বোঝায়, যে ব্যবস্থা দ্রব্যের উৎপাদন ও বণ্টন এবং শাসকদের মনোনয়ন ও অপসারণ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
ব্যাপক অর্থে উদারনীতিবাদ হল এমন একটি মানসিক ধারণা যা তার পূর্ব-সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানুষের সঙ্গে মানুষের বৌদ্ধিক, নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ককে বিচার বিশ্লেষণ করে এবং তাদের মধ্যে একাত্মতা স্থাপণনের জন্য সচেষ্ট থাকে। তাই স্বাধীনতাকেই উদারনীতিবাদের মূল আলোচ্য বিষয় বলা যায়।
বৈশিষ্ট্যসমূহ :
(1) রাজনৈতিক সাম্য :- সংশোধনমূলক উদারনৈতিক রাজনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস হিসাবে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিলেই গণতন্ত্র সফল হবে। বর্তমানে জন বিস্ফোরণসহ রাষ্ট্রের আকৃতি ও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই জনগণের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে শাসন পরিচালনা অসম্ভব। ফলে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমেই রাষ্ট্রপরিচালনা সম্ভবপর। সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমর্থনে গঠিত হলেও দায়িত্বপ্রাপ্তির পর সমগ্র রাষ্ট্র তথা জনগণের ওপর তার কর্তব্য বর্তায় এবং ব্যক্তি, দল, শ্রেণী বা গোষ্ঠীর ঊর্দ্ধে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করে।
(2) রাজনৈতিক ও পৌর অধিকার :- জনমতকে সুষ্ঠু সবল ও জাগ্রত রাখার জন্য উক্ত অধিকারগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। এই অধিকারগুলির মধ্যে রয়েছে- স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার, সভাসমিতির অধিকার, সরকারের সমালোচনা অধিকার, জীবনের অধিকার, ধর্মের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, নির্বাচন করার ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার ইত্যাদি।
(3) একদলীয় ব্যবস্থার বিরোধিতা :- বার্কার প্রমুখদের মতে, বহুদলীয় ব্যবস্থায় জনগণের নানাবিধ আশা-আকাঙ্খা প্রকাশ পায় এবং জনগণ অধিকার বোধ সম্পর্কে সচেতন থাকে। বহুদলীয় ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির কারণ ও তার প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে আলোচনা সমালোচনা করে। ফলে সরকারি দল সেইমত জনস্বার্থে ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এভাবেই সচল থাকে।
(4) গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকার পরিবর্তন :- সরকার গঠনের চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকায় নির্দিষ্ট সময়ের পরে জনগণ শান্তিপূর্ণ সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন করতে পারে। উদারনীতিবাদ বৈপ্লবিক বা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভের সম্পূর্ণ বিরোধী।
(5) সার্বিক ভোটাধিকার :– উদারনীতিবাদের সমর্থকদের মতে, গণতন্ত্র হল জনগণের জন্য জনগণের শাসন, তাই জনগণের চূড়ান্ত সার্বভৌম গণতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের ভোটদানের অধিকার ও প্রয়োগের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যিক।
(6) নিরপেক্ষ আদালত :– সংশোধনমূলক উদারনীতিবাদীদের অভিমত হল, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরপেক্ষ আদালতের প্রয়োজন। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ রক্ষা, সংবিধান রক্ষা ও ব্যাখ্যার দায়িত্ব নিরপেক্ষ আদালতের ওপরই ন্যস্ত থাকবে।
(7) ব্যক্তিগত সম্পত্তি :- দেশের সামগ্রিক উন্নতি, রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যের দায়বদ্ধতা ও স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার নাগরিকদের থাকা প্রয়োজন। কাজের স্বাভাবিক উৎসাহ বজায় রাখার জন্য সম্পত্তির অধিকার থাকা প্রয়োজন।
(8) জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা :- উদারনীতিবাদের মূল কথা জনকল্যাণকর রাষ্ট্র তাই রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি যথেষ্ট বিস্তারের কথা বলা হয়। সর্বপ্রকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য সহনশীল কর ব্যবস্থা, শিল্প-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ, আবশ্যিক শিল্প-বাণিজ্যের জাতীয়করণ, জনমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ উদারনীতির নীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
(9) ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদের বিরোধিতা :- উদারনীতিবাদ স্বৈরাচারী নিয়ন্ত্রণমূলক দমন পীড়নের বিরোধিতা করে ঠিকই কিন্তু নাতসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের পাশাপাশি সাম্যবাদেরও বিরোধিতা করে। উদারনীতিবাদিরা পুঁজিবাদের সমর্থক কিছু ফ্যাসিদের একনেতা এক দলের স্লোগান, ব্যাক্তিতন্ত্র ও অগণতান্ত্রিক যুদ্ধবাদ বৈদেশিক নীতি এবং জাতিবিদ্বেষের চরম বিরোধীতা করে।
সাম্যবাদীদের একদলীয় শাসন ও সর্বহারার একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা, উৎপাদনের উপকরণের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা, শ্রেণীহীন শোষণহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধীতা করে উদারনীতিবাদ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা এবং শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে শোষণ করার জন্য উদারনীতিবাদের সমর্থকেরা সময়ের প্রেক্ষিতে নানারকম তত্ত্ব খাড়া করেন। মূলত বুর্জোয়া সমাজের স্থিতাবস্থা সুরক্ষিত করাই হল উদারনীতিবাদের মূল লক্ষ্য।