প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে কী বোঝ? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতির মধ্যে পাথক্য কী?
উত্তর: মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান সেইরকম আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু কোনো রাষ্ট্রই এককভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাই সব রাষ্ট্রকে তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়। রাষ্ট্রগুলি তার পররাষ্ট্রনীতি এভাবেই গড়ে তোলে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে এই পারস্পারিক সম্পর্ককেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলে। হার্টম্যানের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয় যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে। কে.জে. হলটির মতে, সাধারণভাবে নিয়মিত প্রক্রিয়া অনুসারে পরস্পরের ওপর ক্রিয়াশীল স্বাধীন রাজনৈতিক শর্তাবলীকে নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনাকেই আন্তজাতিক সম্পর্ক বলে।
পামার ও পারকিনস্ বলেছেন, বিশ্বের সব মানুষ ও গোষ্ঠীর যাবতীয় সম্পর্ক, মানুষ্যজীবন, তাদের কার্যকলাপ ও চিন্তার প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি, চাপ ও প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনা করে। তাঁরা রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বিষয়গুলিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
উল্লেখিত সংজ্ঞাগুলির উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা এইরূপ হতে পারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয়, যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতা রাজনৈতিক মতাদর্শ, যুদ্ধ ও শান্তি, নিরস্ত্রীকরণ, আন্তর্জাতিক সংগঠন, স্বার্থগোষ্ঠী, জনমত, প্রচার, কূটনীতি, বিশ্ববাণিজ্য, সন্ত্রাসবাদ, বিশ্ব-পরিবেশ প্রভৃতির মতো প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
পার্থক্য : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে যেসব পার্থক্য রয়েছে সেগুলি হল :
(1) পরিধিগত পার্থক্য : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা ক্ষেত্রের বিষয় বহুবিধ ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশ বিষয়সহ অন্যান্য বিষয়; যেমন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিষয়গুলিও আলোচনাক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া অ-রাজনৈতিক বিষয়গুলিও আলোচ্য সূচীর মধ্যে পড়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতি শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিষয় নিয়েই আলোচনা করে। পামার ও পরিকিনস্-এর মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির তুলনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অনেক বেশি বিস্তৃত। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রাজনৈতিক ও অ-রাজনৈতিক উভয় বিষয় নিয়েই আলোচনা করে।
হলটির অভিমত হল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পররাষ্ট্র থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক নীতিবোধ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক পর্যটন ও মানবজাতির কল্যাণের জন্য নানারকম উপায়সমূহ নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতি সরকারের গৃহীত নীতি ও কর্মসূচীর বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে নিয়ে বিচার ও বিশ্লেষণ করে। সি.এফ. অলজার আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি উপ-আলোচনাক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
(2) বিষয়বস্তুগত পার্থক্য : বাস্তববাদী তাত্ত্বিক মর্গেনথাউ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে মুখ্যত ক্ষমতার লড়াই হিসাবে বোঝাতে চেয়েছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি প্রধানত বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিরোধ ও সংঘর্ষ নিয়ে আলোচনা করে থাকে। অপরদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনাক্ষেত্র হল সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা, শত্রুতা ও মিত্রতা, সংঘর্ষ-সমন্বয় ইত্যাদি। তাই বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের কোন্ দিকগুলোর আলোচনা করা হবে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তাই বলা যায়— আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু অনেক ব্যাপক কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তু তুলনামূলকভাবে গণ্ডীর মধ্যে সীমায়িত।
(3) দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য : কে. জে. হলটির মতানুযায়ী, আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচনায় মুখ্যত বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতার উৎস ও উপাদান, পারস্পরিক সম্পর্ক ও কাজকর্ম ইত্যাদির ওপরে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, যোগযোগব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন, বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়গুলির আলোচনা ও বিশ্লেষণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
পরিশেষে বলা যায় আন্তর্জাতিক রাজনীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি শাখা বা অংশ বলে বিবেচিত হলেও এই অংশটিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মুখ্য ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।