প্রশ্ন : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা লেখো। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের ধারা সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তর : বর্তমান পৃথিবীতে কোনো রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসাবে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে ও জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষার জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর ফলেই গড়ে ওঠে পররাষ্ট্রনীতি। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে বিশ্বের সর্বত্র গমনাগমন যেমন সহজ হয়েছে পাশাপাশি ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষের তাৎক্ষণিক যোগাযোগও সহজ হয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তীব্র প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘ন্যাটো’ ‘সেন্টো’ ‘সিয়াটো’ প্রভৃতি আঞ্চলিক শক্তিজোট গড়ে উঠেছিল। পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ‘ওয়ারশ চুক্তি’ শক্তিজোটও গড়ে উঠেছিল। আবার ভারত, যুগস্লাভিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’ নামে রাষ্ট্রজোট গড়ে উঠেছিল।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে জাতিসংঘ, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, আঞ্চলিক সংস্থাসমূহ, সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট, বহুজাতিক সংস্থা প্রভৃতি অ-রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে। হমান, মোরস, কুপার প্রমুখের মতে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের তুলনায় অ-রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ভূমিকা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কোলম্যান-এর অভিমত হল, আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচনায় জাতি-রাষ্ট্রগুলি এখনো মুখ্য বিষয় হলেও ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। এফ. এস. জনের মতে, জাতীয় সীমানার বাইরে প্রকৃত সম্পর্কের বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে গড়ে ওঠা ‘জ্ঞানের সমষ্টি’কে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলা যায়। হার্টম্যানের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল, যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে, জাতীয় স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে। আবার কুইনসি রাইট বলেন যে, ‘অনিশ্চিত সার্বভৌমিকতার অধিকারী সংগঠন গুলিকে নিয়ে যে শাস্ত্র আলোচনা করে, তাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলে। হফম্যানের মতে, পৃথিবী যেসব মূল এককে বিভক্ত, তাদের বহির্বিষয়ক নীতি ও ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম উপাদানসমূহ ও কার্যাবলী নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনা করে। কে.জে.হলটির মতে, সাধারণভাবে নিয়মিত প্রক্রিয়া অনুসারে পরস্পরের ওপর ক্রিয়াশীল স্বাধীন রাজনৈতিক শর্তাবলী নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনাকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলে।
উপরিউক্ত বিভিন্ন সংজ্ঞার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি সাধারণ সংজ্ঞা বলা যায় :
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয়, যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতা, রাজনৈতিক আদর্শ, যুদ্ধ ও শান্তি, নিরস্ত্রীকরণ, আন্তর্জাতিক সংগঠন, স্বার্থগোষ্ঠী, জনমত, প্রচার, কূটনীতি, বিশ্ববাণিজ্য, সন্ত্রাসবাদ, বিশ্ব পরিবেশ প্রভৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন। যদিও অনেক বিখ্যাত রাষ্ট্রচিন্তাবিদ তাঁদের রচনায় পূর্বেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মূল্যবান মতামত দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্লেটো, অ্যারিস্টটল, থুকিডাইডিস, নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি প্রমুখ।
(1) ইউরোপে নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলন ভূখণ্ডকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভবকে দ্রুততার সাথে বাস্তবায়িত করেছিল। এইসব রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।
(2) ইউরোপ শিল্পবিপ্লবের ফলে বিদেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানির জন্য বিদেশি বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় রাষ্ট্রগুলি একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ও লিপ্ত হত। আধুনিক অস্ত্র-শক্তিতে বলীয়ান রাষ্ট্রগুলি দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে ভীতি প্রদর্শন করে নিজেদের শর্তে মীমাংসা করে নিতে বাধ্য করত। এই পদ্ধতিকে বলা হয় গোপন কূটনীতি।
যাই হোক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোনো সুশৃঙ্খল আত্ম লোচনা ও বিশ্লেষণের পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব সময়কালের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশ একটি সুশৃঙ্খল ও অর্থবহ কার্যক্রমের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
(3) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক পরিণতি জনমানসে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অসংখ্য জীবন ও সম্পত্তিহানি মানুষকে শান্তিকামী করে তোলে। যুদ্ধের অন্যতম কারণ গোপন কূটনীতিকে বর্জন করে বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে জনগণের নিয়ন্ত্রণের দাবিতে জনমত সংগঠিত হয়।
(4) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে লেনিন ও উইলসনের অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। লেনিন তাঁর ‘শান্তির জন্য অনুশাসন’ নীতির প্রয়োগ করে গোপন কূটনীতির বিলোপ সাধন করেছিলেন এবং যাবতীয় বিরোধ মীমাংসা প্রকাশ্যে করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসন ১৯১৮ সালে তাঁর ‘চৌদ্দ দফাপ্রস্তাব’ এর মাধ্যমে সর্বপ্রকার গোপন কূটনীতির অবসান ঘটিয়ে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা, সমরাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি রূপায়ণে বিজয়ী পরাজিত সকল রাষ্ট্রকে সমমর্যাদা সাপেক্ষে ধারাবাহিক আলাপ আলোচনার কথা ঘোষণা করেন।
(5) সমকালীন সময় থেকেই (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য বিভাগ, সমমতাদর্শী গোষ্ঠী ও কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ওয়েলস্ বিশ্ববিদ্যালয়, জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি শিক্ষা কেন্দ্রে আত্ম ন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পঠনপাঠন ও গবেষণা শুরু হয়।
(6) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও পেশাগত সংগঠন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এ প্রসঙ্গে সাময়িক পত্রিকা অস্ট্রেলিয়ান আউটলুক পাশাপাশি পেশাগত সংগঠন ‘আইসা’ ও ‘বিসা-র’ ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ কোয়াটারলি’ ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ রিভিয়ু, ফরেন পলিসি অ্যানালিসিস প্রভৃতি সাময়িক পত্রের ভূমিকাও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক ছিল।
(7) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যথাক্রমে জাতিসংঘ ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ নামে দুটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। বিষয় হিসাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ওই দুটি সংগঠনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জাতিসংঘ লন্ডন, মাদ্রিদ ও প্রাগে পঠনপাঠন সংক্রান্ত তিনটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ব্যবস্থা করেছিল। ওই সম্মেলনগুলির উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পৃথকশাস্ত্র হিসাবে পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করা।
১৯৪৫ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির শক্তিক্ষয় হওয়ার ফলে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের উপনিবেশগুলি পরপর স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পঠনপাঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের বিশেষজ্ঞ স্বংস্থা ১৯৪৮ সালে সেপ্টেম্বরে প্যারিসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সম্মেলন আত্ম হ্বান করে। ওই সম্মেলনের গৃহীত প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসাবে স্বীকার করা হয়।
(৪) ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ঠান্ডা লড়াই-এর অবসান হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র বিশ্বে একক মহাশক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং এই সময় থেকেই একমেরু বিশ্বের সূচনা হয়।
(9) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুরু হয়েছিল জাতি রাষ্ট্রের আলোচনাকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য সূচীর মধ্যে বহু বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌমিকতার চরিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO)-র ভূমিকা ব্যাপক ও চূড়ান্ত।
এইভাবে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবের সময় থেকে বিশ্বায়নের যুগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নানা পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ধারাবাহিক গতিশীল প্রবাহের অভিমুখ বিকশিত হয়ে চলেছে।